করোনা সংক্রমণের নিম্নমুখী প্রবণতায় দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার ঘোষণা আসতেই আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মিশন নিয়ে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে সংঘবদ্ধ ষড়যন্ত্রকারীরা। সরকারবিরোধী ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের দিয়ে এ ছক বাস্তবায়নের গুঁটি সাজাচ্ছে তারা। সরকারকে এ ব্যাপারে সতর্ক করে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এরই মধ্যে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে জামায়াতের শীর্ষ ৯ নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা সরকারবিরোধী কর্মকা-ে লিপ্ত ছিল বলে প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে। এমন প্রেক্ষাপটে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে র্যাব-পুলিশসহ সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সর্বোচ্চ সজাগ থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের কড়া নজরদারিতে রাখার প্রস্তুতি নিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। একই সঙ্গে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির নেপথ্য নায়কদের চিহ্নিত করে তাদের গতিবিধিও নজরদারির প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্রনেতাদের গতিবিধিও কঠোরভাবে মনিটরিং করা হবে। বিশেষ করে হেফাজতের কর্মকা-ের বিষয়ে সরকার বেশি সজাগ রয়েছে।
এ ব্যাপারে এরই মধ্যে সারাদেশে এসপিদের বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে যেসব জেলায় বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, ওই সব জেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বেশি সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) এ ব্যাপারে আগাম তথ্য সংগ্রহে এরই মধ্যে মাঠে নেমেছে।
এদিকে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও এ ব্যাপারে দলীয় নেতাকর্মীদের সজাগ থাকার নির্দেশ দিয়েছে। ষড়যন্ত্রকারীরা শিক্ষাঙ্গনে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালালে তা যাতে শক্তহাতে তাৎক্ষণিক দমন করা যায় সে ব্যাপারে নিজেদের প্রস্তুত রাখার তাগিদ দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি ছাত্রলীগের এক আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, শিগগিরই বিশ্ববিদ্যালয় খুলছে। বিশ্ববিদ্যালয় খুললে অনেক অপশক্তি এবার মাঠে নামবে, চ্যালেঞ্জ করবে। তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরেই তারা অস্থিতিশীলতা তৈরি করবে। শেখ হাসিনার সরকারকে হটানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
সেতুমন্ত্রী আরো বলেন, এখনো বাংলার আকাশে ষড়যন্ত্রের গন্ধ। সতর্ক থাকতে হবে। সামনের দিনে আরো চ্যালেঞ্জ আছে। দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশে ক্ষমতার পরিবর্তনের পর একটি গোষ্ঠী উচ্ছ্বসিত। এখানে তাদের মতলবটা কী? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তুতি চলছে। ফলে অনেক অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় খোলার প্রস্তুতির সঙ্গে সঙ্গে তারা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছে। সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের একটি সূত্র জানায়, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠনের প্রথমসারির নেতাদের ওপর নজরদারি বাড়ানোর জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা রয়েছে। বিশেষ করে ছাত্রদল ও ছাত্র শিবিরের ক্যাডারদের গতিবিধি কঠোরভাবে নজরদারি করতে বলা হয়েছে। সে অনুযায়ী তারা মাঠে কাজ করছে।
সূত্রটি জানায়, গোয়েন্দারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ছাত্র সংগঠনের নেতাদের পৃথক তালিকা তৈরি করছে। একই সঙ্গে তাদের প্রিভিয়াস ক্রাইম রেকর্ড (পিসিআর) খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিগত সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত বিভিন্ন নৈরাজ্যকর ঘটনায় কার, কী ভূমিকা ছিল, তা-ও সুনির্দিষ্টভাবে নিরূপণ করছে গোয়েন্দারা। অল্প সময়ের মধ্যে এ কার্যক্রম শেষে সমন্বিত একটি তালিকা তৈরি করা হবে।
এদিকে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হলগুলো খুলে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে গোয়েন্দারা যাতে আবাসিক ছাত্রদের গতিবিধি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি রাখা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, হলগুলো থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক বিশৃঙ্খলার সূত্রপাত হয়ে থাকে। তাই আবাসিক ছাত্রদের গতিবিধি আগে থেকেই সঠিকভাবে মনিটর করতে পারলে শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা ততটা সহজ হবে না।
এনএসআইয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, মাঠপর্যায় থেকে তারা যে তথ্য পেয়েছে, তাতে ছাত্র সংগঠনের ব্যানারে আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ছক সাজানো হলেও তাদের ইস্যুগুলো ছাত্র অধিকার সংশ্লিষ্ট নয়। তারা মূলত সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও দুঃশাসনের অভিযোগ তুলে আন্দোলনে নামার পরিকল্পনা করছে।
গোয়েন্দাদের আশঙ্কা যে অমূলক নয়, তা ছাত্রফ্রন্টের শীর্ষ নেতাদের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গত ২ সেপ্টেম্বর ঢাবি ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে ছাত্রফ্রন্টের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শোভন রহমান বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে এবার সরকারের দুর্নীতি-দুঃশাসনের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে। ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নূরের বক্তব্যেই একই ধরনের আভাস পাওয়া গেছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এ কারণে তারা সর্বোচ্চ সজাগ রয়েছে। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতা ও ক্যাডার- যারা বিভিন্ন সময় নানা নৈরাজ্যকর ঘটনায় নেতৃত্ব দিয়েছে তাদের তালিকা হাতে নিয়ে এরই মধ্যে নজরদারির প্রস্তুতি চূড়ান্ত করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় খোলার আগে থেকেই তারা মনিটরিং কার্যক্রম শুরু করবে। করোনা মহামারির এই দুঃসময়ে কোনো ইস্যুতে যাতে শিক্ষাঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে না ওঠে এ ব্যাপারে তারা সর্বোচ্চ তৎপর থাকবে। দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এমনিতে শিক্ষার্থীদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে। এ ওপর বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর কোনো অপশক্তির ষড়যন্ত্রে শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্য সৃষ্টি হলে সরকার তা ফের বন্ধ করে দিতে বাধ্য হতে পারে। তাই সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। নিজেদের স্বার্থেই ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে তাদেরও সোচ্চার হতে হবে। তা না হলে এর খেসারত তাদেরই দিতে হবে বলে মনে করেন দায়িত্বশীল ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে ডিএমপি অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ) কৃষ্ণ পদ রায় বলেন, সরকারবিরোধী সব ধরনের কর্মকাণ্ডের ওপরই গোয়েন্দা নজরদারি থাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। তবে দীর্ঘদিন পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কারণে সরকারবিরোধী ছাত্র সংগঠনের ওপর পুলিশের বিশেষ নজরদারি রয়েছে। বিশেষ করে হেফাজতে ইসলাম। তারা যেন কোনো ধরনের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড না ঘটাতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখা হচ্ছে।
নয়া শতাব্দী/এমআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ