ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

জেলখানায় পরিকল্পনা বাইরে বাস্তবায়ন

নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ’
প্রকাশনার সময়: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৯:৫৬ | আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৯:৫৮

ফের নতুন জঙ্গি সংগঠনের সন্ধান। নাম তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ (আল-জিহাদী)। নড়েচড়ে বসেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নেমেছে তথ্য প্রমাণ সংগ্রহে। এরইমধ্যে পুলিশের এন্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ) সংগঠনটির প্রধানসহ আটক করেছে কয়েকজনকে। রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে মিলেনি উল্লেখযোগ্য তথ্য। আর তাই সংগঠনটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে মাঠে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন জেলায় অভিযান চালিয়ে তাওহীদুল উলূহিয়্যাহর প্রধানসহ তিনজনকে আটক করে পুলিশের এন্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ)। এরপর তাদের চারদিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তবে তাদের থেকে পর্যাপ্ত তথ্য পায়নি আইনশৃঙ্খরা রক্ষাকারি বাহিনী। গ্রেফতারা এর আগেও বিভিন্ন নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিল। এর দায়ে তারা র‍্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়ে বিভিন্ন মেয়াদে জেলও খেটেছেন। এটিইউ মনে করছে— নতুন সংগঠনটির প্রধান মো. জুয়েল মোল্লা এর আগে জঙ্গি তৎপরতার কারণে গ্রেফতার হয়ে ৯ মাস জেল খেটেছেন। এ সময় জেলে বসেই নতুন জঙ্গি সংগঠন করার পরিকল্পনা করেন জুয়েল। বিষয়টি নিয়ে জেলখানায় থাকা অন্য জঙ্গি সদস্যদের সঙ্গে সলাপরামর্শও করেন তিনি। এরপর বের হয়ে ‘তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ (আল-জিহাদী)’ নামের নতুন এই সংগঠন তৈরি করেন। জুয়েল মোল্লা মূলত সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। পেশা একটি বেকারি কারখানায় শ্রমিকের কাজ করতেন। তবে একাডেমিক জ্ঞান না থাকলেও তার ইচ্ছে ছিল একটি ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। সে লক্ষ্যেই সবাইকে একত্রিত করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি দেশের প্রচলিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা মানতেন না। যে কারণে দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে চেয়েছিলেন।

জানতে চাইলে অপরাধবিজ্ঞানী মাহবুব নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘আইডোলজিক্যালি যারা উজ্জীবিত তাদেরকে যদি সাধারণ কয়েদিদের সঙ্গে রাখেন তাহলে তারা সেখানে তাদের আইডোলজির প্রচার করবে। তখন জেলখানা সংশোধনাগার না হয়ে ‘রিক্রুট সেন্টার’ হয়ে যাবে। তাই কোনোভাবেই এ ধরনের আসামিদের কোনো কমন সেশনে রাখা যাবে না। এ বিষয়টিতে সরকারকে দৃষ্টি দিতে হবে।’ জানতে চাইলে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শাহিন হাওলাদার নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘আসলে জেলখানা অপরাধীদের সংশোধনের জন্য। সেখানে গিয়ে কেউ যদি অপরাধ করার পরিকল্পনা করে বা করার সুযোগ পায় তাহলে তা অবশ্যই চিন্তার বিষয়। জেলকোড অনুযায়ী নির্দেশনা রয়েছে— কোথাও কোন আসামিকে রাখলে সেখানে অপরাধ সংগঠনের শঙ্কা থাকলে তাদের অন্যজেলে স্থানান্তর করা যাবে। তিনি বলেন, ‘জেলখানায় এ ধরনের অপরাধীদের কোনোভাবেই একসঙ্গে রাখা যাবে না। এ ধরনের জঙ্গি ও উগ্র মতবাদে যারা বিশ্বাসি তারা যেখানেই যাক সেখানেই তাদের চিন্তা-ধারা প্রচার করবে। তাই তাদের ওপর বিশেষ নজর রাখতে হবে। তাদেরকে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই জেল কর্তৃপক্ষকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে বলেও মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের এ আইনজীবী।

এটিইউ সূত্রে জানা গেছে, সংগঠনটির বয়স মাত্র ৩ থেকে ৪ মাস। সবেমাত্র কার্যক্রম শুরু করেছিল এ সংগঠনটি। ইতোমধ্যেই সদস্য সংখ্যা ৭০ থেকে ১০০ জন বলে ধারণা করছে এটিইউ। শুরুতেই সংগঠনের প্রধানকে গ্রেফতার করাটাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সফলতা হিসেবেই দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। সংগঠনটি মূলত ‘তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ (আল-জিহাদী)’ নামের ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ থেকে এই কার্যক্রম পরিচালনা করত। এ ছাড়াও তাদের একাধিক ফেসবুক আইডি ও পেজ ছিল। যা দিয়ে তারা তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করত। সংগঠনটির কার্যক্রম পরিচালনা সম্বলিত নির্দেশনার কিছু স্কিনশর্ট এসেছে নয়া শতাব্দীর হাতে। সেখানে দেখা যায়, চলতি বছরের ১৪ জুলাই ‘সৎ ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ’ নামের একটি আইডি থেকে পোস্ট করা হয় ‘বাংলার জমিন রক্তের নদীতে পরিণত হবে’। এ পোস্টের নিচে ‘গাজওয়াতুল হিন্দের সৈনিক’ নামের একটি আইডি থেকে কমেন্ট করা হয় ‘কবে?’, উত্তরে ‘সৎ ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ’ নামের আইডি থেকে জানানো হয় ২০২৪ সালে। ফলে অনুমেয় যে এই জঙ্গি সংগঠনটি আগামী বছর বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা নিয়ে আগাচ্ছিল। এটিইউ সূত্রে জানা গেছে— ‘সৎ ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ’ মূলত জুয়েল মোল্লা। তিনিই এ সংগঠনটির প্রধান।

জানতে চাইলে এটিইউ-এর এক কর্মকর্তা বলেন, গ্রেফতারকৃত তিনজন এর আগে একসঙ্গে হয়নি। তবে তারা অনলাইনে মিটিং করেছে। তাদের একত্রিত হওয়ার পরিকল্পনা ছিল। তিনি বলেন, ‘আসলে আমাদের আদালত থেকে মাত্র চারদিনের রিমান্ড দেয়া হয়েছে। এরপর আবার আরও রিমান্ডের আবেদন করেছিলাম। কিন্তু আমরা পাইনি। চারদিন সময় তো এনাফ না যে কারণে আমরা তেমন তথ্য পাইনি।’

এটিইউ সূত্রে জানা গেছে, গ্রেপ্তারকৃত বাকি দুইজন হলেন মো. রাহুল হোসেন (২১) ও মো. গাজিউল ইসলাম (৪০)। গ্রেপ্তার মো. রাহুল হোসেন মূলত সংগঠনির আইটির বিষয়গুলো দেখতেন। রাহুল পেশায় একটি আইটি কোম্পানিতে চাকরি করতেন। তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করে সংগঠনের জন্য সদস্য সংগ্রহ করতেন। এ ছাড়াও রাহুল সংগঠনের ফান্ড সংগ্রহের জন্য নিজের জমি বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি বোমা তৈরির দায়িত্বেও ছিল। যে কারণে তাদের অস্ত্র এবং বিস্ফোরক সংগ্রহের জন্য অর্থের প্রয়োজন ছিল। তাই রাহুল অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করছিলেন। এ অর্থ দিয়ে তারা অস্ত্র কেনা সহকারে বোমা তৈরি সরঞ্জাম সংগ্রহ করার পরিকল্পনা করছির। এ অস্ত্র ও বোমা দিয়ে তাদের বড় ধরনের জঙ্গি হামলার পরিকল্পনা ছিল। তাদের মূল লক্ষ ছিল— মূলত দেশকে ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। তবে তার আগেই তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। তারা যে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতায় জড়িয়েছেন এই বিষয়ে কিছুই জানত না তাদের পরিবার।

এটিইউ সূত্রে আরও জানা গেছে, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য জসীম উদ্দিন রহমানি যিনি বর্তমানে কারাগারে আছেন। তার বক্তব্যে মূলত উদ্বুদ্ধ হয় জুয়েল মোল্লা। এর ফলে তিনি নতুন এ জঙ্গি সংগঠনটি সৃষ্টি করে। জুয়েল নিজেও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য ছিলেন। আর বাকি গ্রেপ্তার দুজন জবুত তাওহীদের সদস্য ছিলেন। জসীম উদ্দিন রহমানিকেও কারাগার থেকে মুক্ত করার পরিকল্পনা ছিল জুয়েলের।

এটিইউ’র এক অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, তাদের পরিকল্পনা ছিল ২০২৪ সালে দেশে বড় ধরনের জঙ্গি হামলা করা। আমরা গত কয়েক মাস ধরে গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে খবর পাচ্ছিলাম কিছু উগ্রবাদী মানুষ একত্রিত হচ্ছে। যারা কিনা দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বিশ্বাস করে না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বানচাল করে উগ্রবাদী ব্যবস্থা কায়েমের জন্য তারা একত্রিত হচ্ছিল। গ্রেপ্তাররা সবাই আগে কোনো না কোনো জঙ্গি সংগঠনের সদস্য ছিল। কিন্তু তারা নতুন লক্ষ্য নিয়ে একটি ব্যানারের তলে সবাই নতুন করে একত্রিত হচ্ছিল। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ভিডিও এবং পোস্টের মাধ্যমে নতুন সদস্য সংগ্রহ করে আসছিল। এ দলের প্রতিষ্ঠা ও প্রধান নেতা হলেন জুয়েল। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তাদের কোনো হামলার পরিকল্পনা ছিল কি না, তাদের অর্থদাতা কারা কিংবা ২০২৪ সালে কোন কোন যায়গায় হামলার পরিকল্পনা ছিল— এসব বিষয়ে বিস্তারিত কোনো তথ্য নেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে।

জানতে চাইলে এটিইউ’র এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আসলে এসব জঙ্গি সংগঠনের এক গ্রুপের কাজ সম্পর্কে অন্য গ্রুপ জানে না। এবং এক গ্রুপের সদস্যদের অন্য গ্রুপের সদস্যরা চিনেও না। আমরা এখনও মাত্র একটা গ্রুপকে ধরতে পেরেছি। আরও কয়েকটা গ্রুপ আমাদের নজরদারিতে রয়েছে। তাদের গ্রেফতার করতে পারলে হয়তো আরও বিস্তারিত জানা যাবে।’

জানতে চাইলে এটিইউ’র পুলিশ সুপার (অপারেশনস্) মাহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমরা গোয়েন্দা নজরদারির ভিত্তিতে তথ্য পেয়ে তাদের গ্রেফতার করি। এই সংগঠনটির ২০২৪ সালে দেশে বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা ছিল। শুরুতেই আমরা তাদের ধরতে সক্ষম হই। এ দলে আরও সদস্য রয়েছে। যারা আমাদের নজরদারিতে রয়েছে। এরা বারবার স্থান পরিবর্তন করতেছে। অনেকেই গা ঢাকা দিয়েছেন। তবে আমাদের নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। যে কোনো সময় তাদেরকেও আমরা গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসব। তখন এই সংগঠনের বিষয়ে আরও বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে।

নয়াশতাব্দী/জেডএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ