ঢাকা, রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফ্রিল্যান্সিং ‘ফাঁদে’ তরুণীরা

প্রকাশনার সময়: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৮:২৫

তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে জ্যামিতিক হারে বেড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ইন্টারনেটের ব্যবহার। আর এ সুযোগে অনলাইনে পরিচয়ের সূত্র ধরে ফ্রিল্যান্সিং কাজের লোভ দেখিয়ে ভিডিও কলে কথোপকথন ও পরে আপত্তিকর মুহূর্তের ভিডিও রেকর্ড করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এক শ্রেণির প্রতারকরা।

ফ্রিল্যান্সিংয়ের কথা বলে স্ক্রিন রেকর্ডারের মাধ্যমে শত শত নারীকে ফাঁদে ফেলা এমন এক প্রতারককে গ্রেফতারের পরে এ বিষয়ে জানতে পেরেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের সাইবার এন্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগ।

ডিবি জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে আপত্তিকর মুহূর্তের ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা বেড়েছে। এমন অভিযোগে গত শুক্রবার নাসিম আলম নামের এক প্রতারককে কুমিল্লার দেবিদ্বার এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। ৩ দিনের রিমান্ড শেষে গত সোমবার তাকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। গ্রেফতারের সময় তার কাছ থেকে শতাধিক নারীর ভিডিও কলের স্ক্রিন রেকর্ড উদ্ধার করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টাকার প্রতি মাত্রাতিরিক্ত লোভ ও স্মার্টফোনের যথাযথ ব্যবহার না জানায় এমন প্রতারণার শিকার হচ্ছেন তরুণীরা।

ডিবির তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজের কথা বলে মেয়েদের সঙ্গে আলাপচারিতা শুরু হলেও সেটি একসময় রূপ নিত প্রেমের সম্পর্কে। পরে ভিডিও কলে বিশেষ মুহূর্তের ভিডিও রেকর্ড করে স্বজনদের কাছে পাঠানো ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে কিছুদিন পরপর হাতিয়ে নেয়া হতো লাখ লাখ টাকা।

গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নাসিম ডিবিকে জানিয়েছে, প্রথমে বিভিন্ন মেয়েদের টার্গেট করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বন্ধুত্বের অনুরোধ পাঠাতেন তিনি। এরপর তাদের সঙ্গে কথা বলে ভালো সম্পর্ক তৈরি করে বিশ্বস্ততা অর্জন করতেন। কাউকে চাকরি পাইয়ে দেয়া বা ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ শিখিয়ে দেয়ার প্রলোভন দিতেন। এভাবেই গড়ে উঠত প্রেমের সম্পর্ক। এরপর ওই নারীদের কৌশলে আপত্তিকর অবস্থায় ভিডিও কলে কথা বলতে রাজি করাতেন। ওই সময় ভিডিও স্ক্রিন রেকর্ড করে রাখা হতো। এরপর বের হতো তার আসল চেহারা। ওই ভিডিও পাঠিয়ে শুরু করতেন ব্লাকমেইল। স্বজনদের কাছে পাঠিয়ে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে বিকাশের মাধ্যমে হাতিয়ে নিতেন লাখ লাখ টাকা। যারা টাকা দিতে পারতেন না তাদের কাছ থেকে নিতেন স্বর্ণালঙ্কার।

নাসিমের ফাঁদে পড়ে সর্বস্ব হারানো ভুক্তভোগী জাকিয়া সুলতানা (ছদ্মনাম) বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নাসিমের সঙ্গে পরিচয় হয়। এরপর ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজের কথা বলে কৌশলে মোবাইল নাম্বার নেয়। এরপর ফেসবুক মেসেঞ্জার ও ওয়াটসঅ্যাপে কথা বলে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে। এরই মধ্যে বিভিন্ন কৌশলে আপত্তিকর অবস্থায় কথা বলতে বাধ্য করে। পরে ওই ভিডিও রেকর্ড করে আমার কাছ থেকে সাড়ে ৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। শুধু স্ক্রিন রেকর্ডই নয়, নিকটাত্মীয়দের আপত্তিকর মুহূর্তের ভিডিও করে তাদেরও ব্ল্যাকমেইল করতেন। তেমনই এক প্রতারক মানিক হককে প্রথমে মানিকগঞ্জের শিবালয় এলাকা থেকে গ্রেফতার করে ডিবি সাইবার এন্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অর্গানাইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম। এক নিকটাত্মীয়ার বাসায় নিয়মিত যাতায়াত ছিল তার। তিনি ওই আত্মীয়ার (তরুণী) আপত্তিকর কিছু ছবি তুলে রাখেন। পরে মেসেঞ্জারের মাধ্যমে ওই তরুণীকে ছবিগুলো পাঠিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে চাপ দিতে থাকেন। রাজি না হলে ছবিগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিতে থাকেন। পরে ওই তরুণীর বাবা বাদী হয়ে গত ২৬ আগষ্ট পল্লবী থানায় পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা (নং-৫৯) দায়ের করেন। ওই মামলার তদন্তে নেমেই পরে নাসিমকে গ্রেফতার করা হয়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার অপরাধ বিভাগের তথ্য অনুযায়ি, গত চার বছরে সাইবার ক্রাইম ইউনিটে প্রায় পাঁচ হাজার অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে কেবল গত ছয় মাসে প্রায় ২ হাজার লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। এতে তদন্তে নেমে হিমশিম খেতে হচ্ছে পুলিশকে। এর পাশাপাশি প্রতি বছরই এই সংক্রান্ত মামলার সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেখানে ২০২০ সালে সাইবার মামলা বৃদ্ধির হার ছিল ১৫ শতাংশ। যা ২০২১ সালে হয়েছে ৭ শতাংশ আর ২০২২ সালে সেটি গিয়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ শতাংশে। আর চলতি বছরের গত ৮ মাসে তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২৯ শতাংশ। গত ১০ মাসে সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত ১৬৩৫টি মামলা হয়েছে। সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের ৬৮ শতাংশ নারী সাইবার স্পেসে নানাভাবে হয়রানির শিকার হন। সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়া এসব নারীর প্রায় সবাই তরুণী। এদের বয়স ১৪ থেকে ২৩ বছরের মধ্যে।

ফ্রিল্যান্সিংয়ের নামে ফাঁদে ফেলে প্রতারণার বিষয়ে ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের সাইবার সিকিউরিটি বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, সাইবার প্রতারকরা ফ্রিল্যান্সিংয়ের নামে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ভিডিও কলে আপত্তিকর মুহূর্তের ভিডিও রেকর্ড করে শত শত নারীকে ফাঁদে ফেলছে। এর থেকে নিরাপদ থাকতে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্বল্প সময়ের পরিচয়ে কারও সঙ্গে গভীর সম্পর্ক স্থাপন থেকে বিরত থাকা, যার-তার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট (বন্ধুত্বের আবেদন গ্রহণ) না করা, অনলাইনে কাউকে নিজের ছবি বা ভিডিও না পাঠানো এবং আপত্তিকর অবস্থায় ভিডিও কলে কথা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে। এরপরেও যদি কেউ ব্লাকমেইলের স্বীকার হয়, তাহলে পুলিশের সাইবার বিভাগে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন ডিবির এ কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, আউসোর্সিং ও ফ্রিল্যান্সিংয়ের নামে প্রতারণা নতুন কিছু নয়। প্রায় বছরখানেক হলো এই ধরনের প্রতারণার মুখোমুখি হয়েছেন অনেকেই। বিশেষ করে মেয়েরা। তবে তাদের মধ্যে বেশিরভাগই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে কোনো ধরনের অভিযোগ করে না।

তিনি আরও বলেন, সাইবার বুলিংয়ে জড়িত অনেককেই আমরা আইনের আওতায় নিয়ে আসার কাজ করছি। এটা শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক নয়। আমাদের এই কার্যক্রম সারা দেশব্যাপী। কিন্তু মৌখিকভাবে তারা আমাদের কাছে জানালেও সামাজিক ট্যাবুর কারণে মামলা করতে চান না। আর মামলা না হলে আমাদের জন্য পদক্ষেপ নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। আমাদের কাছে তরুণীদের যত অভিযোগ আসে তার অধিকাংশই প্রেমঘটিত সাইবার ক্রাইম। এসব ক্ষেত্রে তরুণীদের আরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। সাইবার ক্রাইম এখন যে পর্যায়ে চলে গেছে লজ্জা আর ভয় পেয়ে থাকলে চলবে না। হয়রানির শিকার হলে ভুক্তভোগীদের অবশ্যই পুলিশের সহায়তা নিতে হবে।

নয়াশতাব্দী/জেডএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ