ভারি বর্ষণ এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে নীলফামারীর তিস্তা নদীর পানি বেড়ে বিপদসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে পানি নিয়ন্ত্রণ করতে ৪৪টি গেট খুলে দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
এছাড়া কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর. ঈশ্বরদী, বগুড়া, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর ও রাজবাড়ীসহ দেশের সকল নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
নীলফামারী : চতুর্থ দফায় নীলফামারীর ডালিয়া ব্যারাজ পয়েন্টে শুক্রবার দুপুরে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
তিস্তার পানি পরিমাপক (গেজ পাঠক) মো. নরুরুল ইসলাম জানান, শুক্রবার সকাল সাড়ে নয়টায় বিপদসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও সকাল ছয়টায় বিপদসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে।
নীলফামারীর ডালিয়ার খালিশাচাঁপানী তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে তিস্তার বিপদসীমা হচ্ছে ৫২.৬০ মিটার। এর আগে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টায় বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। এদিকে পানি বৃদ্ধির ফলে দশটি ইউনিয়নের প্রায় দশ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এতে নতুন করে ভাঙন আতঙ্কে তিস্তাপাড়ের মানুষ।
গত ২৯ আগস্ট গভীর রাতে ডিমলা উপজেলায় ভেন্ডাবাড়ী কুটিপাড়া এলাকার তিস্তা ডানতীর বাঁধের ৪০ মিটার সলিট স্পারটি পানির তোড়ে ভেঙে যায়। তীব্র স্রোতে বিস্তীর্র্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে ভয়াবহ ভাঙনের মুখে বিলীন হয়ে যায় কুটিপাড়া এলাকার দুই শতাধিক পরিবারের বসতভিটা ও ফসলি জমি।
কুড়িগ্রাম : ব্রহ্মপুত্র নদের পানি হুহু করে বৃদ্ধি পাওয়ায় উলিপুর, চিলমারী, রৌমারী ও চর রাজিবপুরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বসতভিটায় পানি প্রবেশ করায় লোকজন বাড়িঘর ছেড়ে বাঁধে অথবা আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। চারদিকে পানি ওঠায় দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। বয়স্ক ও নারীদের জন্য ল্যাট্রিন সমস্যা প্রকট হয়েছে। তৃণমূলভূমি তলিয়ে যাওয়ায় গবাদি পশুর তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। নিম্নবিত্তরা এক বেলা খেয়ে আরেক বেলা থাকছে অনাহারে।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম জানান, শুক্রবার সকালে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে ৫০ সেন্টিমিটার এবং ধরলা নদীর পানি ব্রিজ পয়েন্টে ২৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়াও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ১ সেন্টিমিটার নিচে অবস্থান করছে।
সিরাজগঞ্জ : বন্যায় ২৮টি ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সিরাজগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির এখন আরো অবনতি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধ পয়েন্টে ৯ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৬৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
শুক্রবার সকাল ৬টায় যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধির বিষয়টি নিশ্চিত করেন সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের শহর রক্ষা বাঁধ পয়েন্টের দায়িত্বে থাকা গেজ মিটার (পানি পরিমাপক) আব্দুল লতিফ। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চল। এতে জেলার পাঁচটি উপজেলার ২৮টি ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ায় তাদের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে।
জামালপুর : উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। জামালপুরে গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে ১৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৬৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে শুক্রবার বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু সাঈদ ও পানি মাপক আব্দুল মান্নান।
এদিকে জেলার ৭টি উপজেলার কমপক্ষে ৩৫টি ইউনিয়ন বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।
জেলার ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. নায়েব আলী জানান, জেলার ৭টি উপজেলায় বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। এতে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
তিনি আরো বলেন, এ পর্যন্ত ৬৫টি পরিবার নদী ভাঙনের শিকার হয়েছেন।
ঈশ্বরদী : ফের ঈশ্বরদীর পদ্মার পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঈশ্বরদীর ছলিমপুর ইউনিয়নের বক্তারপুর মামনি কৃষি খামারের রাস্তা অর্থাৎ খয়ের দায়েরের পাকা রাস্তা বন্যার পানির স্রোতে ভেঙে গেছে। তলিয়ে গেছে হাজার হাজার বিঘা ফসলি জমি।
শুক্রবার ঈশ্বরদীর বক্তারপুর মামনি কৃষি খামারের রাস্তাটি খয়ের দাইর পাওয়ার কয়েক কিলোমিটার আগেই বন্যার পানিতে এলজিইডির পাকা রাস্তাটি ভেঙে, বেশকিছু মেহগনি, আম ও লিচুর গাছ উপড়ে পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।
এলাকাবাসী ও মামনি কৃষি খামারের মালিক আলহাজ্ব শাহজাহান আলী পেঁপে বাদশা জানান, বাঙালপাড়া এলাকার আবুল শাহর বাড়ির পাশ দিয়ে যে জোলা আছে সেই জোলা দিয়ে পানি এসে বক্তারপুর গ্রামের অনেক এলাকা ডুবে গেছে। ইতোমধ্যে ৩০০০ বিঘা জমির ফসল পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।
বগুড়া : পাহাড়ি ঢল ও প্রবল বর্ষণে বগুড়ার সারিয়াকান্দির নিকট যমুনা বাঙ্গালী নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
শুক্রবার দুপুরে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৬৯ সেমি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপরদিকে বাঙ্গালী নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৩ সেমি. নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়াও জেলার ধুনট ও সোনাতলায় বন্যার পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেছে।
টাঙ্গাইল : যমুনাসহ সকল নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি ৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৬৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়াও ধলেশ্বরী ৭৩ ও ঝিনাই নদীর পানি বিপদসীমার ৮৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এতে করে নদীতীরবর্তী টাঙ্গাঈল সদর, কালীহাতি, নাগরপুর, ভূঞাপুর ও বাসাইল উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এর ফলে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে।
এদিকে বন্যাদুর্গত এলাকার কৃষকরা জানান, গত এক সপ্তাহের বন্যায় তাদের কৃষির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আমন ধান ও সবজি ক্ষেত তলিয়ে গেছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের দেয়া তথ্যানুযায়ী জেলায় এখন পর্যন্ত ৭৫০ হেক্টর আমন ধান বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।
ফরিদপুর : গোয়ালন্দ পয়েন্টে পদ্মা নদীর পানি ৮ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৬৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর ফলে ফরিদপুরের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছে।
ফরিদপুর সদর, চরভদ্রাসন, ভাঙ্গা ও সদরপুর থানার ২৩৪ গ্রামের মানুষ ১৮ দিন ধরে পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। ভেঙে গেছে সড়ক। হয়েছে ফসলের ক্ষতি। এইসব এলাকাসহ মধুখালী ও আলফাডাঙ্গার টগরবন্দ ইউনিয়নেও দেখা দিয়েছে নদী ভাঙন। চাহিদার তুলনায় ত্রাণ তৎপরতা তেমন চোখে পড়ছে না।
রাজবাড়ী : পদ্মার পানি বেড়েই চলেছে। এতে নিম্নাঞ্চলসহ বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
শুক্রবার জেলার তিনটি গেজ স্টেশন পয়েন্টে পদ্মার পানি বেড়ে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে ১৩ ইউনিয়নের ৬৭ গ্রামের ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১ হাজার ৪৫ হেক্টর ফসলি জমি।
শুক্রবার পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে এসব তথ্য জানা যায়।
পাউবো সূত্রে জানা যায়, সকাল ৬টায় পরিমাপ করা তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় রাজবাড়ীর তিনটি পয়েন্টে পদ্মার পানি বেড়ে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে গোয়ালন্দের দৌলতদিয়া গেজ পয়েন্টে পদ্মার পানি ৮ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৬৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
নয়া শতাব্দী/এম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ