ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

নেটওয়ার্ক তছনছ আরসার!

প্রকাশনার সময়: ২৫ জুলাই ২০২৩, ০৯:১৩
ছবি : সংগৃহীত

র‍্যাব-পুলিশের ধারাবাহিক অভিযানে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে আরসার সদস্যরা। এরই মধ্যে অনেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছেড়ে পাহাড়ে অবস্থান নিয়েছে। আবার অনেকে সীমান্তের শূন্য রেখায় অবস্থান করছে। এ কারণে সীমান্তে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি পাহাড়ে অবস্থানকারীদের ধরতে র‍্যাবের অভিযান আরও জোরদার করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দাবি, সম্প্রতি র‍্যাব-পুলিশের অভিযানে আরসার দুই কমান্ডার নিহত ও বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে আরসার গোপন কর্মকাণ্ড। সেই তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালানো হচ্ছে। এতে তছনছ হয়েছে গেছে আরসার নেটওয়ার্ক।

পাহাড়ে তাদের আস্তানা সম্পর্কেও তথ্য রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে। ড্রোন ক্যামেরায় ধরা পড়ছে ওই আস্তান ছবি। সেখান থেকে পাওয়া ছবিতে যাদের দেখা গেছে তাদেরকেও শনাক্ত করা হয়েছে। ওই সন্ত্রাসীরা যেন সাধারণ রোহিঙ্গার ছদ্মবেশে ফের ক্যাম্পে ভিড়তে না পারে সেদিকেও খেয়াল রাখা হচ্ছে।

জানতে চাইলে র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, দিনকে দিন আরসা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছিল। বিষয়টি টের পেয়ে ওই এলাকায় ধারাবাহিক অভিযান চালানো হচ্ছে। এতে গ্রেফতার হয়েছেন অনেকে। তাদের কাছ থেকে আরসার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বিস্তর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এ ছাড়া র‍্যাবের গোয়েন্দারাও তাদের বিষয়ে অনুসন্ধান করেছে। সব মিলিয়ে অভিযান চালানো হচ্ছে। বলতে গেলে তাদের নেটওয়ার্ক অনেকটাই তছনছ।

জানা গেছে, কক্সবাজারের টেকনাফ শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরের শালবাগান পাহাড় ঘিরে গড়ে উঠেছে নয়াপাড়া ২৬-২৭ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্প। আর সেই পাহাড় ঘিরে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে ৪ শতাধিক আরসা সন্ত্রাসী।

৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পাহাড়টির একেক অংশের একেক নামকরণ রয়েছে। এরমধ্যে শুধু শালবন অংশটুকুই রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠে। অন্তত ১০টি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপ এখানে সক্রিয়। তারা খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, মাদক ও মানব পাচারসহ সব অপকর্মে জড়িত।

স্থানীয়দের দাবি, রোহিঙ্গাদের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়ন্ত্রণ থাকলেও গহিন এ পাহাড়ের পুরোটাই তাদের অজানা। এ কারণে এতদিন তাদের নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হয়েছে। যা এখন তাদের নখদর্পনে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, পাহাড়ে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী আদ্দু বাহিনী, গিয়াস বাহিনী ও সালমান শাহ বাহিনী। এ ছাড়া আছে জাকির বাহিনী, পুতিয়া বাহিনী, খালেক বাহিনী, জাকারিয়া গ্রুপ ও মুন্না গ্রুপ।

জাকির বাহিনীর জাকির ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হলে এই বাহিনীর হাল ধরে তার বড় ভাই দিল মোহাম্মাদ আর জামিল। সম্প্রতি টেকনাফের গহিন পাহাড়ে গোপন আস্তানা থেকে র‍্যাবের হাতে আটক সংগঠনটির সামরিক কমান্ডার হাফেজ নুর মোহাম্মদসহ আরসার ছয় শীর্ষ সন্ত্রাসীর কাছ থেকে র‍্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে আরও অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য। মিয়ানমারে থাকতে তারা কে কী করতেন, কে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিতেন, কে বোমা বানাতেন এবং বাংলাদেশে এসে তারা কীভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন এবং কে কোন দায়িত্বে ছিলেন, তারা নিজেরাই র‍্যাবের কাছে এসব তথ্য জানিয়েছেন বলে নিশ্চিত করেন র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন।

শুক্রবার রাতে টেকনাফের গহিন পাহাড়ে আরসা’র একটি গোপন আস্তানা থেকে প্রথমে সংগঠনটির সামরিক কমান্ডার হাফেজ নুর মোহাম্মদকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তার স্বীকারোক্তি মতে আরসার আরোও পাঁচ সন্ত্রাসীকে প্রেপ্তার করে র‍্যাব। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে ১টি ৭.৬৫ এমএম পিস্তল, ১টি বিদেশি রিভলবার, ১টি শর্টগান, ৪টি দেশীয় তৈরি এলজি, ৩টি দেশীয় রামদা, গুলিসহ নগদ ৭০ হাজার টাকা উদ্ধার করে র‍্যাব।

র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, গ্রেপ্তার হওয়া ৬ জনই আরসার সক্রিয় সদস্য। তারা সবাই শীর্ষ সন্ত্রাসী। নূর মোহাম্মদ উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের অন্যতম সামরিক কমান্ডার হিসেবে আরসার নেতৃত্ব দিয়ে আসছে।

তার নেতৃত্বে আরসার ৩০-৩৫ জন সদস্য ওই ক্যাম্প ও আশপাশের এলাকায় খুন, অপহরণ, ডাকাতি, মাদক, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। এমনকি তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য তারা পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে দুর্গম সীমান্তবর্তী অঞ্চল দিয়ে অস্ত্র চোরাচালান করত।

হাফেজ নূর তার দলের সদস্যদের মাধ্যমে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে খুন, অপহরণ ও গুমের ভয় দেখিয়ে চাঁদা দাবি করত। চাঁদার অর্থ না পেলে ভিকটিমকে অপহরণ করে শারীরিক ও পাশবিক নির্যাতন এবং মুক্তিপণ দাবি করত। মুক্তিপণ না পেলে তারা ভিকটিমকে খুন করে গহিন পাহাড়ে অথবা জঙ্গলে লাশ গুম করে ফেলত, বলেন খন্দকার মঈন।

তিনি বলেন, ২০১৬ সালে হাফেজ নূর মোহাম্মদ আরেক আরসা সদস্য আরিফ উদ্দিনের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আরসায় যোগ দেন। যোগদানের পর পর সে আরসার সেকশন কমান্ডারের দায়িত্ব পায়। সে কুংফুতে ব্ল্যাক বেল্ট প্রাপ্ত ও বিস্ফোরক তৈরিতে পারদর্শী। মিয়ানমারে থাকতে সে আরসার অন্যান্য সদস্যদের কুংফু প্রশিক্ষণ দিত।

আরসার সামরিক শাখার প্রধান ওস্তাদ খালেদের কাছ থেকে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ ও আরসার মূল সংগঠক আরিফ উদ্দিন হাসেম ওরফে কুইল্লার কাছ থেকে বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ নেয় নূর। পরবর্তীতে সে ২০১৭ সালে অবৈধভাবে বাংলাদেশে এসে বালুখালীর ৮ নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরে অবস্থান করে।

প্রাথমিকভাবে সে ক্যাম্প-৮-এ আরসার হেড জিম্মাদার হিসেবে দায়িত্ব পায়। তার নেতৃত্বেই কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পের আরসার সদস্যরা খুন, টার্গেট কিলিং, অপহরণ, ডাকাতি, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছিল।

এই গ্রুপের হাতে খুন হয়েছেন, হেড মাঝি, সালাম, সলিম, মালেক, হাবুইয়া, ইমান, আবুল মুনসুর ও সালেহ। এছাড়া সম্প্র্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আলোচিত ৬ জনের হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ছিল হাফেজ নূর।

জানা গেছে, সন্ত্রাসী সংগঠন আরসার জন্য চাঁদা সংগ্রহ করে ক্যাম্পের জিম্মাদারদের মাঝে বণ্টন করতো হাফেজ নূর। এছাড়াও ২০২২ সালের নভেম্বরে গোয়েন্দা সংস্থা ও র‍্যাবের মাদকবিরোধী যৌথ অভিযানের সময় সন্ত্রাসীদের হামলায় গোয়েন্দা সংস্থার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিহত এবং একজন র‍্যাব সদস্য গুরুত্বর আহত হন।

এ ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল হাফেজ নূর। সে অপহরণ ও টার্গেট কিলিং শেষে কক্সবাজারের গহিন পার্বত্য এলাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় আত্মগোপনে থাকত বলে জানা যায়। তার বিরুদ্ধে উখিয়া, নাইক্ষ্যংছড়িসহ বিভিন্ন থানায় হত্যা, অপহরণ, অস্ত্রসহ বিভিন্ন অপরাধে ১৫টির বেশি মামলা রয়েছে বলে জানায় র‍্যাব।

সূত্রমতে, ১০ জুলাই আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন রোহিঙ্গা অপরাধী ও আরসা কমান্ডার হোসেন মাঝি। নিহত হোসেন মাঝি আরসার অন্যতম শীর্ষ নেতা ছিলেন। কক্সবাজারের ৭ থেকে ৮টি শরণার্থী শিবিরে তার নির্দেশে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হতো বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার ১৪ এপিবিএনের অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) সৈয়দ হারুন অর রশীদ।

এর আগে গত ১২ এপ্রিল কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এপিবিএনের সঙ্গে গোলাগুলির ঘটনায় নিহত হন আরসার কমান্ডার আব্দুল মজিদ প্রকাশ লালাইয়া। নিহত আরসা কমান্ডার আব্দুল মজিদ প্রকাশ লালাইয়া উখিয়ার ১৩ নম্বর ক্যাম্পের নরুল আমিনের ছেলে এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৪টি হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি।

এপিবিএন এর ৮ ব্যাটালিয়নের সহকারী পুলিশ সুপার মো. ফারুক আহমেদ জানান, সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ঘণ্টাব্যাপী উখিয়ার ১৯ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এ গোলাগুলি চলে। এ সময় অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করা হয় আরসার আরো তিন সন্ত্রাসীকে।

পুলিশের দাবি বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে নানা ধরনের চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই শেষে পরিকল্পনা মাফিক অভিযান চালানো হচ্ছে। এ কারণে এখন তারা আরও গহিন পাহাড়ে চলে গেছে। আবার অনেকে সীমান্তের শূন্যরেখায় অবস্থান করছে। তারা যেন আর ক্যাম্পের আশপাশে ভিড়তে না পারে এজন্য বাড়ানো হয়েছে কঠোর নজরদারী। পাশাপাশি গোয়েন্দারাও সব সময় সতর্ক রয়েছে।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ