পর্যটন নগরী কক্সবাজারে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরসা ও আরাকান সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও)। মিয়ানমারের ভাষায় আরসার সদস্যরা তনজিম এবং আরবি ভাষায় আল ইয়াকিন নামে পরিচিত। এ দুই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্যরা অপহরণ, খুন, চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসাসহ নানা ধরনের অপরাধে যুক্ত রয়েছে। এখান থেকে পাওয়া অর্থ দিয়েই তারা অস্ত্র সংগ্রহ ও নিজেদের খরচ মেটান। এমনকি তাদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও। সীমান্তের শূন্য রেখায় অবস্থান করে তারা একের পর এক অপরাধ কর্ম করে যাচ্ছে। এমনকি এ সন্ত্রাসীরা দিনের আলোয় সাধারণ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিশে থাকলেও রাতে দেখা যায় তাদের ভিন্ন রূপ। সর্বশেষ শুক্রবার অপর একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাতে খুন হন আরসার ৫ সদস্য। আরাকান সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) নামের ওই সংগঠনটি আরসার প্রতিপক্ষ। এ দুই গ্রুপের কারণে এখন কক্সবাজার প্রশাসনে অস্বস্তি বিরাজ করছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
সার্বিক এমন পরিস্থিতিতে এ দুই গ্রুপের সদস্যদের তালিকা নিয়ে অভিযান শুরু করা হয়েছে। সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থার তালিকায় দেখা গেছে কক্সবাজার ও টেকনাফের ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পেই তাদের সদস্যরা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে নতুন তালিকা ধরে অভিযানে নেমেছে এপিবিএনসহ (আর্মড পুলিশ ব্যটালিয়ন) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। যদিও বেশিরভাগ সন্ত্রাসীরাই সীমান্তের শূন্য রেখায় অবস্থান করে এবং তাদের কিছু সদস্য পরিচয় গোপন রেখে ক্যাম্পে অবস্থান করে। মূলত তারা মূল দলের সোর্স হিসাবে ক্যাম্পে অবস্থান করে তথ্য পাচার করে। একই সঙ্গে শুধু নানা ধরনের অপকর্মের সময় ক্যাম্পের অবস্থানকারীরা প্রকাশ্যে আসেন এবং কাজ শেষে তারা ক্যাম্প ত্যাগ করেন। ক্যাম্প ছেড়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের পরিচয় গোপনই থাকে। ক্যাম্প ত্যাগকারী সদস্যরা মূল দলের সঙ্গে অবস্থান করে নতুন করে সোর্স তৈরি করে। এ কারণে তাদের সন্ধান পেতে গোয়েন্দাদের বেগ পেতে হয় বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চ পর্যায় সূত্রে জানা গেছে।
এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতনরা আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্যে না দিলেও নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি সূত্র জানায়, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, মানবপাচারসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যে তার সঙ্গে এ দুই গ্রুপের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে তাদের ওপর কঠোর নজরদারি চালানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা কিছু তালিকা দিয়েছে। সেগুলো যাচাই বাছাই করা হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার একটি সূত্র জানায়, আরসার এসব সদস্যরা অস্ত্র ও মাদক চোরাকারবারে সক্রিয়ভাবে জড়িত। তারা ক্যাম্পে নাম লেখালেও বেশিরভাগ সময় শূন্যে রেখায় অবস্থান করে। আবার কিছু সদস্য সাধারণ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিলেমিশে সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে। সম্প্রতি শূন্য রেখায় ডিজিএফআইয়ের এক কর্মকর্তাও মাদক চোরাকারবারিদের হাতে নিহত হন। ওই ঘটনার পর আরসার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। যদিও আগে থেকেই সরকার তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্যানুযায়ী, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অন্তত দেড় শতাধিক হত্যাকাণ্ড হয়েছে। এর মধ্যে ২০২১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ এরশাদ নামে একজন স্বেচ্ছাসেবক খুন হন। ২১ সেপ্টেম্বর খুন হন মোহাম্মদ জাফর নামের এক নেতা (মাঝি)। ১৮ সেপ্টেম্বর খুন হন আরেক স্বেচ্ছাসেবক মোহাম্মদ ইলিয়াস। এছাড়া ২০২২ সালের ৯ আগস্ট দুই রোহিঙ্গা নেতা, ৮ আগস্ট টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক স্বেচ্ছাসেবক খুন হন। ১ আগস্ট একই ক্যাম্পে সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক নেতা মারা যান। ১ আগস্ট উখিয়ার মধুরছড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবক, গত ২২ জুন কথিত আরসা নেতা মোহাম্মদ শাহ এবং ১৫ জুন একই গ্রুপের সদস্য মো. সেলিম সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন। ১৬ জুন রাতে উখিয়া ক্যাম্পে স্বেচ্ছাসেবক, ১০ জুন কুতুপালংয়ের ৪ নম্বর ক্যাম্পের আরেক স্বেচ্ছাসেবক, ৯ জুন এক রোহিঙ্গা নেতা, জুনের শুরুতে মে মাসে খুন হন রোহিঙ্গা নেতা সানাউল্লাহ ও সোনা আলী। এছাড়া ২০২১ সালের ২২ অক্টোবর ক্যাম্প-১৮ এর একটি মাদ্রাসায় ৬ জনকে হত্যা করা হয়। এর আগে একই বছরের ২৯শে সেপ্টেম্বর হত্যা করা হয় রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাহকে। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ৭ জুলাই আরাকান সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) নামের একটি সন্ত্রাসী সংগঠনের হাতে খুন হন আরসার ৫ সদস্য।
স্থানীয় সূত্রের দাবি, আরসার সদস্যরা ঘটনার দিন শুক্রবার সশস্ত্র অবস্থায় ক্যাম্পে এসে এক মাঝিকে খুঁজতে থাকেন। খবর পেয়ে তাদের ঘিরে ফেলেন আরএসও দলের সদস্যরা। এ সময় আরএসও দলের গুলিতে নিহত হন আরসার ৫ সদস্য। স্থানীয়দের দাবি, প্রতিটা রোহিঙ্গা ক্যাম্পেই আরসা ও আরএসও এর সোর্স রয়েছে। তারা সীমান্তে ও পাহাড়ে অবস্থানকারী দুই গ্রুপের সদস্যদের গোপনে তথ্য পাচার করে। সর্বশেষ ঘটনায় আরএসও গ্রুপের এক মাঝিকে খুন করার জন্য আরসার সদস্যরা ক্যাম্পে আসেন। কিন্তু তাদের আসার খবরটি মুহূর্তেই আরএসও গ্রুপের কাছে পৌঁছে গেলে সংঘর্ষের ঘটনায় হতাহত হয়।
সূত্রমতে, মিয়ানমারের এ দুই গ্রুপের হাতে এখন জিম্মি প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা। তাদের কথার বাইরে চললেই তাকে খুন হতে হচ্ছে। সম্প্রতি তাদের হাতে গুরুতর আহত হন আর্মড পুলিশের এক সদস্য। সাদা পোশাকে থাকায় তাকে পুলিশের সোর্স হিসাবে হামলা চালানো হয়। এ ঘটনার পর নড়েচড়ে বসে গোয়েন্দারা। শুরু করে আরসা নামের তালিকার হালনাগাদ। ওই হালনাগাদ তালিকার একটি কপি রয়েছে নয়া শতাব্দীর হাতে। সেখানে প্রায় শতাধিকের ওপরে নামের তথ্য রয়েছে।
ওই তালিকায় দেখা গেছে, ২ নং ক্যাম্পের এর কমান্ডার মৌলভী আয়াছ, কলিমউল্লাহ, জাহিদ হোসেন, মোহাম্মদ ফরিদ, ইউসুফ, জামাল, পূর্ব আরমান, বাইলা, ক্যাম্প ফরিদ, মুছা, সানাউল্লাহ, এর সেলিম উল্লাহ, সালাম, ছলিমউল্লা, মৌলভী ছামছু, কলিমউল্লাহ, জাহিদ হোসেন, ফরিদ, ইউছুফ, জামাল, সলিম উল্লাহ, মৌলভী সামছু ও সেলিম উল্লাহ। এছাড়া ৪ নম্বর ক্যাম্পের আরমান, ৬ এর আব্দুল মালেক, আব্দুল হালিম, মাস্টার সাইফ উদ্দিন, ১৭ এর সিরাজ, এনাম মাস্টার হোসেন, ইলিয়াছ, মৌলভী নুর, সালাম, হাসিম, বালুখালীর মৌলভী হামিদ হোছন, মাস্টার নূর বশর, ক্যাম্প নাশাপ্রু মন্ডু মৌলভী সেলিম, ১ এর মাস্টার ফারুক, মাঝি আব্দুর ছবি, হাফেজ আয়াছ, লতিফ আলী, মাঝি সাইফুল্লাহ, ওসমান, হবির আম্মদ, মাঝি আইয়ূব, দিল মোহাম্মদ প্রকাশ মার্স, মোহাম্মাদ রফিক, ৭ এর আব্দুল মাবুদ (হেড মাঝি), আইয়াছ (সাব মাঝি), আবুবক্কর, হাফেজ, কেফায়েত উল্লাহ্, হয়দার লেংড়া হায়দার, ৫ এর ভুট্টু আব্দুল্লাহ (হেড মাঝি), ওস্তাদ খালেক, হেড মাঝি জহিরুল, আব্দুল হাফেজ, আলী (৪০), মধু ছড়া জিয়া মুক্তি জিয়া, ৬ এর মোছা মিয়া, মৌলভী নুর মোহাম্মাদ, মৌলভী হোসেন আহম্মাদ, মৌলভী নুরুল আমিন, কেফায়েত উল্লাহ্, ১ এর নূর কবির, নূর হোসেন, হাবিবউল্লাহ, সৈয়দুল আমিন (সাব মাঝি) শাহ আলম, কালা মিয়া (ব্লক ই), ফরিদউল্লাহ, সিরাজ, হাসিম, আজিম উল্লাহ, ৪ এর আলম, রফিক, সলিম, ৫ এর মৌলভী শহিদুল ইসলাম, মৌলভী জালাল, আলিম, সলিমউল্যা, ১ এর নবী হোসেন, ৬ এর রফিক, ৭ এর হেড মাঝি মাবুদ, ৬ এর হেড মাঝি জহিরুল, ৭ এর কেফায়েত উল্লাহ, ৫ এর হেড মাঝি ভুট্টু, ৫ এর মুক্তি জিয়া, ৬ এর মুছা মিয়া, ৭ এর সাব মাঝি আইয়াছ, ১ নম্বর ক্যাম্পের এর নুর কবির, মাস্টার এনাম, হাবিবুল্লাহ, সাব মাঝি সৈয়দুল আমিন, শাহ আলম, কালা মিয়া ৬ এর মৌলভী নুর মোহাম্মদ, মৌলভী হোসেন আহাম্মেদ, মৌলভী নুরুল আমিন, ৭ এর আব্দুল হাফেজ, মো. আলী, ৬ এর কেফায়েত উল্লাহ, ২ এর হাফেজ আয়াজ, নুর সাফা, লিয়াকত আলী, এহসান উল্লাহ, মাস্টার মুন্না, শামসুল আলম, জাফর, মুছা, জাবেদ, মাস্টার দিল মোহাম্মদ, ৮ এর নবী হোসেন, ৯ এ নুরুল আমিন, ১০ এর সৈয়দুল ইসলাম, ইসলাম, ৯ এর নুরুল আমিন, শাহিদ, ১১এর নুর কামাল, জাফর আলম, ১০ এর হামিদ হোসেন, ১১ এর তোফাহেন ও মৌলভী হাবিবুল্লাহ।
সূত্রমতে, উখিয়ার কুতুপালং মেগাক্যাম্পের লম্বাশিয়া শিবিরের এআরএসপিএইচ কার্যালয়ে ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মুহিবুল্লাহকে এবং বালুখালীর দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়াহ মাদ্রাসায় ছয়জনকে হত্যার ঘটনায় ক্যাম্পজুড়ে অস্থিরতা দেখা দেয়। এর নেপথ্যে নিহতের স্বজনরা রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠন আরসাকে দায়ী করলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বরাবরই বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের আরসার অস্তিত্ব নেই। যদিও সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরসার অস্বিত্বের খবর গণমাধ্যেমে নিশ্চিত করেন। এবং তাদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর অবস্থানে যাচ্ছেন বলে জানান।
নয়া শতাব্দী/আরআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ