কুড়িগ্রামে নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধিতে সাড়ে ১৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল নিমজ্জিত। এছাড়া নীলফামারীর ডিমলায় তিস্তার স্পার বাঁধ ও কুটিপাড়ার দেড়শ’ পরিবার ও কয়েকশ’ একর ফসলি জমি নদীতে, জামালপুরে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত, পানিবন্দি ১২ হাজার মানুষ, শেরপুরের পাহাড়ি ঢলে ভোগাই নদের ভেঙে যাওয়া তিন কিলোমিটার বাঁধ সংস্কার না হওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন এলাকাবাসী, সিরাজগঞ্জে যমুনার পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এবং পানি বৃদ্ধির ফলে দুর্ভোগে বন্যাকবলিত মানুষ, ফরিদপুরের মধুখালীতে মধুমতী নদীর তীব্র ভাঙনের কবলে কয়েকটি গ্রাম ও টানা বৃষ্টিতে পাবনায় যমুনা নদীর পানি বাড়লেও অন্যান্য নদ-নদীর পানি স্থিতিশীল রয়েছে। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
কুড়িগ্রাম : নদ-নদীতে আবারো পানি বৃদ্ধি শুরু হয়েছে। এক দিনেই ধরলা নদীতে ১০ সেন্টিমিটার ও ব্রহ্মপুত্র নদে ৫ সেন্টিমিটার পানি বেড়েছে। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম জানান, সোমবার সকালে ধরলা নদীর পানি ব্রিজ পয়েন্টে ৩৪ সেন্টিমিটার এবং ব্রহ্মপুত্র নদে চিলমারী পয়েন্টে ২৩ সেন্টিমিটার বিপদসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধির ফলে ভাঙন কমেছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক কৃষিবিদ মঞ্জুরুল হক জানান, বন্যার পানি নিম্নাঞ্চলে অবস্থান করায় কৃষকের আরাধ্য ফসল রোপা আমন ও শাকসবজি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সোমবার পর্যন্ত জেলায় ১৫ হাজার ৫২০ হেক্টর জমির ফসল নিমজ্জিত হয়েছে। এর মধ্যে রোপা আমন ১৫ হাজার ১১৫ হেক্টর, শাকসবজি ২৭০ হেক্টর এবং বীজতলা ৯৫ হেক্টর।
কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিএম আবুল হোসেন জানান, পানি বৃদ্ধির ফলে নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলে পানি প্রবেশ করেছে। এতে আমার ইউনিয়নের প্রায় ৪ শতাধিক বাড়িতে পানি উঠেছে। নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাওয়ায় গো-খাদ্যের সংকট তৈরি হয়েছে। লোকজন পানিতে ডুবে বিভিন্ন জায়গা থেকে গো-খাদ্য সংগ্রহ করছে। এছাড়াও বসতবাড়ীতে পানি প্রবেশ করায় স্বাভাবিক চলাচলে অসুবিধা সৃষ্টি হয়েছে।
নীলফামারী : তিন দিনের টানা বর্ষণ আর উজানের ঢলে ফুঁসে উঠেছে তিস্তা নদী। পানির তোড়ে নীলফামারীর ডিমলার ঝুনাগাছ চাপানী ইউনিয়নের দক্ষিণ সোনাখুলীর ডান তীর বাঁধের দুই নম্বর স্পার বাঁধ গত রোববার মধ্য রাতের পর ভেঙে গেছে।
এ স্পার বাঁধটি ভেঙে পড়ায় ভেন্ডাবাড়ী এলাকার কুটিপাড়ার দেড়শ’ পরিবার ও কয়েকশ’ একর ফসলি জমি ইতোমধ্যে বিলীন হয়েছে তিস্তায়। ফলে ভেন্ডাবাড়ী আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ আশপাশের চার শতাধিক পরিবার পড়েছে ভাঙনের মুখে।
সোমবার ঝুনাগাছ চাপানী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আমিনুর রহমান জানান, রোববার রাত দুইটার দিকে স্পার বাঁধটির ৬০ ফুট দৈর্ঘ্য আর ২৫ ফুট প্রস্থে তিস্তায় বিলীন হয়। বাঁধের অবশিষ্ট অংশে ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। তিস্তা নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ায় পানি উন্নয়ন বোডর্, ডালিয়া ডিভিশন বালুর বস্তা ফেলে বাঁধটি রক্ষার চেষ্টা করেছে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ভেন্ডাবাড়ী এলাকার বন্যাকবলিত লোকজন ঘরবাড়ি ভেঙে নিয়ে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিচ্ছে।
জামালপুর : উজানের পাহাড়ি ঢল ও কয়েক দিনের টানা বৃষ্টির কারণে যমুনা এবং ব্রহ্মপুত্রের পানি বেড়েছে। এতে জেলার ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ ও বকশীগঞ্জ উপজেলার নিম্নাঞ্চলসহ প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। তিন উপজেলার ১০-১২ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বেশ কিছু কাঁচা-পাকা সড়ক ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ ফসলি জমি পানিতে ডুবে গেছে।
সোমবার জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু সাইদ জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় জামালপুরে যমুনা নদীর পানি বেড়ে বিপদসীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী তিন দিন আরো পানি বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসার পরেশ চন্দ্র দাশ জানান, জেলার ৫০ হেক্টর জমি পানিতে প্লাবিত হয়েছে। দু-একদিনের মধ্যে পানি না কমলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়বে বলে জানান তিনি।
শেরপুর : নালিতাবাড়ীতে টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ভোগাই নদের ভেঙে যাওয়া তিন কিলোমিটার বাঁধ সংস্কার না হওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন এলাকাবাসী। ইতোমধ্যে ভাঙনের দুই মাস পেরিয়ে গেছে। আবার পাহাড়ি ঢল এলে ভাঙন অংশ দিয়ে পানি প্রবেশ করে সদ্য রোপণ করা আমনের ফসল ক্ষতির আশঙ্কা করছেন স্থানীয় কৃষক।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, ৩০ জুন উপজেলায় টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে নয়াবিল ইউনিয়নের চারআলী, হাতিপাগার এলাকায় তিনটি অংশ, নয়াবিল এলাকায় দুটি অংশ ও নাকুগাঁও স্থলবন্দর এলাকায় ২ হাজার ৫০০ মিটার ভোগাই নদের বাঁধের ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া নয়াবিল এলাকায় তিনটি অংশে ৫০০ মিটার এবং পৌরসভার নিচপাড়া, উত্তর গড়কান্দা, গোবিন্দনগর ও খালভাঙ্গা এলাকায় আরও ৫০০ মিটার বাঁধ ভেঙে যায়। এই ভাঙন অংশ দিয়ে সে সময় পানি প্রবেশ করে উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এতে ২৫টি বাড়ি সম্পূর্ণ ও ২০০ বাড়িঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঢলের পানিতে ১ হাজার ১৫০টি পুকুরের মাছ ভেসে যায়। ২০০ হেক্টর আমনের বীজতলা ও ২৫০ হেক্টর আউশের ফসল পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সিরাজগঞ্জ : উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও বর্ষণে সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। বসতবাড়ি ও রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন বন্যাকবলিত মানুষ। জেলার বিভিন্ন স্থানে তাঁত কারখানায় পানি উঠে পড়ায় বেকার হয়ে পড়েছেন শ্রমিকরা, তাঁত মেশিন নষ্ট হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মালিকরা।
সোমবার সকালেও সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধ পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে যমুনা নদীর পানি।
কাজীপুর মেঘাই ঘাট পয়েন্টে অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে যমুনা নদীর পানি। যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। ইতোমধ্যে নদীতীরবর্তী পাঁচটি উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
সোমবার সিরাজগঞ্জ ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আব্দুর রহিম জানান, যমুনা নদীবেষ্টিত জেলার কাজীপুর, সদর, বেলকুচি, শাহজাদপুর ও বেলকুচি উপজেলার প্রায় ২৫টি ইউনিয়নে পানি প্রবেশ করেছে।
মধুখালী : ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার কামারখালী ইউনিয়নে গড়াই ও মধুমতীর নদীর পানি বৃদ্ধি ও তীব্র ভাঙনে মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। নদী ভাঙনের কবলে পড়ে সালামতপুর বর্তমান রউফনগর গ্রামের নদীর পাশ দিয়ে মানুষের যাতায়াতের রাস্তা বিলীন হয়ে গেছে। অনেক ঘরবাড়ি নদীতে চলে গেছে। বর্তমান বসতবাড়ি, মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং জাদুঘর চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। এ ব্যাপারে নদীর পাশে বসবাসকারী মো. বাদশা, জাকির, কালামসহ অনেকে বলেন, বিগত ১০ বছরের চেয়ে এবার নদীর ভাঙন বেশি। যেভাবে নদীর ভাঙন শুরু হয়েছে তাতে মনে হয় গ্রামের অনেকের ঘরবাড়ি ও জাদুঘর রক্ষা করা যাবে না। নদীতে চলে যাবে। তাই নদীর বাঁধ অতীব জরুরি।
পাবনা : উজানের ঢল আর টানা বৃষ্টিতে পাবনায় যমুনা নদীর পানি বাড়লেও অন্যান্য নদ-নদীর পানি স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। এদিকে নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকে সবজি ও ফসলের ক্ষেত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহকারী পরিচালক মোশারফ হোসেন জানান, সোমবার সকালে যমুনা নদীর নগরবাড়ি পয়েন্টে পানি বেড়ে বিপদসীমার ৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পদ্মা নদীর পানি পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে বিপদসীমার ৭২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে এবং বড়াল নদীর পানি কিছুটা বেড়ে বড়াল ব্রিজ পয়েন্টে বিপদসীমার ৩৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পাবনা সদর, ঈশ^রদী, বেড়াসহ কয়েকটি উপজেলার নদীতীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকে সবজি ও ফসলের ক্ষেত তলিয়ে গেছে।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গেল কয়েক দিনের বন্যায় জেলায় প্রায় সাড়ে আটশ’ হেক্টর জমির সবজিসহ বিভিন্ন ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
নয়া শতাব্দী/এম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ