ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

দুই দেশের গলার কাঁটা কুকি-চিন

প্রকাশনার সময়: ১১ জুন ২০২৩, ১১:০৬ | আপডেট: ১১ জুন ২০২৩, ১১:০৮

দেশের পার্বত্যাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি-চিনের বেশ কিছু সদস্য প্রতিবেশী দেশ ভারতের মিজোরাম রাজ্যের পাহাড়ে আত্মগোপন করেছে। বান্দরবান ও রাঙামাটির সীমান্ত এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর অভিযানে টিকতে না পেরে তারা পাশে মিজোরাম রাজ্যে আত্মগোপন করে। বাংলাদেশের সীমান্তের ওপারে মিজোরামের গভীর পাহাড়ি জঙ্গলে কুকি-চিনের ঘাঁটি রয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কুকি-চিনকে দমন করতে ভারতের বিএসএফের সহায়তা চাইছে বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। আজ রোববার ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লিতে অনুষ্ঠিত বিজিবি-বিএসএফ ডিজি পর্যায়ের বৈঠকে বিষয়টি বিজিবি’র পক্ষ থেকে উত্থাপন করা হবে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

বিজিবি সদর দফতরের একটি সূত্র জানায়, বৈঠকে আত্মগোপন করা সন্ত্রাসীদের একটি তালিকাও বিএসএফের কাছে হস্তান্তর করা হবে। এদের ধরিয়ে দেয়ার সহায়তা চাইবে বিএসএফের কাছে। তালিকায় মাদক ব্যবসায়ী, চোরকারবারী এবং আরাকান কেন্দ্রিক জঙ্গি সংগঠন আরাকান আর্মি, রোহিঙ্গা কেন্দ্রিক জঙ্গি সংগঠন আরসা, বান্দরবান-রাঙামাটি কেন্দ্রিক বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি-চিনের ক্যাডার বাহিনীর নাম রয়েছে। কুকি-চিনের আত্মগোপন করা প্রধান নেতা নাথান বমের নামও রয়েছে ওই তালিকায়।

বিজিবির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশের মাটি সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। আমাদের সেনাবাহিনী এ ব্যাপারে পাহাড়ে পাহাড়ে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে। সীমান্ত রক্ষী বাহিনী হিসাবে বিজিবিও সেনাবাহিনীর সঙ্গে অভিযানে অংশ নিচ্ছে। বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি-চিন আমাদের সীমান্ত সড়ক নির্মাণ কাজে বাধা দেয়ার চেষ্টা করছে। যেভাবেই হোক সেনাবাহিনী এ সীমান্ত সড়ক নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, সীমান্ত সড়ক নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানের প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় দুই দেশের মধ্যে চোরাকারবারি, মাদক ব্যবসায়ী, বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সন্ত্রাসীদের আনাগোনা বন্ধ হয়ে যাবে।

ভারতের নয়া দিল্লিস্থ বিএসএফ চাওলা ক্যাম্পে বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের ৫৩তম সীমান্ত সম্মেলনে দুই দেশের সীমান্ত নিয়ে আলোচ্যসূচিতে থাকছে সীমান্ত এলাকায় নিরস্ত্র বাংলাদেশির ওপর গুলি করে আহত বা হত্যা বন্ধ করা বিষয়টি গুরুত্ব পাবে। এ বিষয়ে দু’দেশের সীমান্তে সহিংস ঘটনা রোধ ও সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসার জন্য অতিরিক্ত পর্যবেক্ষণের কথা উত্থাপন করা হবে। বাংলাদেশি নাগরিকদের অপহরণ, আটক, অবৈধভাবে আন্তর্জাতিক সীমান্ত অতিক্রম, অস্ত্র ও গোলা-বারুদ পাচার, জাল নোটের লেনদেন, সীমান্তের অপর প্রান্ত থেকে বাংলাদেশে ফেন্সিডিলসহ মাদক চোরাচালান বন্ধ, আন্তর্জাতিক সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে উন্নয়নমূলক নির্মাণ কাজ, উভয় দেশের সীমান্তে নদীর তীর সংরক্ষণ কাজে সহায়তা এবং উভয় বাহিনীর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা বৃদ্ধির উপায় নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হবে।

বিজিবি সদর দফতর থেকে জানান হয়, সীমান্ত সম্মেলনে যোগ দিতে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এ কে এম নাজমুল হাসানের নেতৃত্বে ১৪ সদস্যের বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল গতকাল দুপুরে ভারতের নয়া দিল্লিতে পৌঁছেছেন। নয়া দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রতিনিধি দলকে স্বাগত জানান বিএসএফ মহাপরিচালক ড. সুজয় লাল থাওসেন। সম্মেলনে বিএসএফ মহাপরিচালকের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের ভারতীয় প্রতিনিধিদল নেবেন। আগামী ১৪ জুন সকালে সম্মেলনের ‘যৌথ আলোচনার দলিল’ স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি হবে।

পার্বত্য এলাকা বান্দরবানের নতুন আতঙ্কের নাম বিচ্ছিন্নবাদী সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। অপহরণ-খুন-মুক্তিপণ আদায় এবং জঙ্গি প্রশিক্ষণের মতো গুরুতর অপরাধে তাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাচ্ছে। স্থানীয় অন্যান্য বিচ্ছন্নবাদী সংগঠনের সঙ্গেও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে অশান্ত পরিবেশ তৈরির উসকানিও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এমনকি তাদের হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না পার্বত্য এলাকার নিরাপত্বার দায়িত্বে থাকা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা। খুন করা হচ্ছে বাহিনীর সদস্যদেরও। সর্বশেষ মঙ্গলবার দুপুরে তাদের হামলায় মারা যান দুই সেনা সদস্য। আহত হন আরও দুই কর্মকর্তা। এমন পরিস্থিতিতে সাড়াষি অভিযানের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন স্থানীয় নিরিহ বাসিন্দারা। যদিও নতুন এই সংগঠনের দৈরাত্ম্য রুখতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা কাজ করে যাচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

সূত্রমতে, কেএনএফ মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানকেন্দ্রিক আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠন। পার্বত্য তিন জেলার প্রায় অর্ধেক আয়তনের লামা, রুমা, আলীকদম, থানচি, রোয়াংছড়ি, বিলাইছড়ি, জুরাইছড়ি ও বরকলসহ আশপাশের এলাকা নিয়ে একটি মনগড়া মানচিত্র তৈরি করেছে কেএনএফ। প্রস্তাবিত মানচিত্রের তিন দিকে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্ত। পাহাড়ের বম, পাঙ্খুয়া, খুমি, ম্রো এবং খিয়াং নামক ক্ষুদ্র ছয়টি জাতি-গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠন হয়েছে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ। সংগঠনের লোগোতে প্রতিষ্ঠাকাল ২০০৮ সাল বলে উল্লেখ থাকলেও মূলত ২০১৮ সালের পর থেকে সশস্ত্র কাঠামোয় মাথাচাড়া দিতে থাকে সংগঠনটি।

সবশেষ গত বছরের অক্টোবর মাস থেকে কুকিদের ভয়ঙ্কর রূপ জনসমক্ষে আসে। এই সংগঠনের সদস্যরা বান্দরবানের থানচি সড়ক নির্মাণের কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করতে গত ১১ মার্চ ১২ শ্রমিককে অপহরণ করে। এদের মধ্যে একজন শ্রমিক গুলিবিদ্ধ হয়। এ ছাড়া সাত শ্রমিককে মুক্তিপণের বিনিময়ে ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সড়ক নির্মাণ কাজে আর না যাওয়ার শর্তে ছেড়ে দেয়। বাকি চার শ্রমিককে এখনো কেএনএ জিম্মি করে রেখেছে বলে জানা যায়। সেই ধারাবাহিকতায় পরের দিন গত ১২ মার্চ দুপুরে বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে অতর্কিতে গুলিবর্ষণ করে টহলরত সেনাবাহিনীর এক সদস্যকে (মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার নাজিম উদ্দিন) হত্যা এবং দুজনকে আহত করে কুকি সন্ত্রাসীরা।

তার আগে গত ৮ ফেব্রুয়ারি বান্দরবানের ৩ উপজেলায় ‘কেএনএফ’ গাড়ি চলাচল বন্ধের জন্য পরিবহন মালিক সমিতিকে হুমকি দিয়ে নোটিস জারি করে। যার মূল উদ্দেশ্য বান্দরবানকে পর্যটকশূন্য করা। গত ১৭ মে বুধবার সেনাবাহির টহল দলের সদস্যদের ওপর হামলা চালিয়ে ২ সেনা সদস্যকে খুন করেন। এ ঘটনার পর সম্প্রতি কুকি-চিনের পেতে রাখা আইইডি বিস্ফোরণে আরও এক সেনা কর্মকর্তা নিহত হন। এরপর সাড়াষি অভিযানে কুকি-চিনের প্রশিক্ষণ শিবির দখলে নেয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা। পরে বান্দরবান সফর করেন সেনাপ্রধান। এ সময় তিনি পাহাড়ে শান্তি ফেরাতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণা দেন।

নয়া শতাব্দী/আরআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ