নীলফামারীর তিস্তায় পানি বৃদ্ধি ও চরাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় দেখা দিয়েছে নদী ভাঙন। এছাড়া কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকায় পানিবন্দি জীবনযাপন করছে অন্তত ৩০ হাজার মানুষ, মানিকগঞ্জে ৩০ হাজার মানুষের চিকিৎসাকেন্দ্রটি পদ্মায় বিলীন, রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে পদ্মাতীরবর্তী এলাকা প্লাবিত ও তিস্তার পানি বৃদ্ধির ফলে রংপুরের ৩টি উপজেলার চরাঞ্চলসহ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
নীলফামারী : ভারি বর্ষণের ফলে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে চরাঞ্চলগুলো প্লাবিত হওয়ায় দেখা দিয়েছে তীব্র নদী ভাঙন। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে পাঁচ হাজার পরিবার।
রোববার সকাল ৬টায় নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার ডালিয়া তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে নদীর পানি বিপদসীমার (৫২.৬০) ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। বিকেল ৩টায় পানি কমে বিপদসীমার ১২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানান তিস্তার পানি পরিমাপক (গেজ পাঠক) মো. নুরুল ইসলাম।
এর আগে রাতে ওই পয়েন্টে বিপদসীমার ৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নীলফামারীর ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার চরাঞ্চলগুলে বন্যা ও ভাঙন শুরু হয়। গত ২৪ ঘণ্টায় নীলফামারীর তিস্তা অববাহিকায় ৪৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
এদিকে নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে ডিমলা উপজেলার ঝুনাগাছ চাপানি, টেপাখড়িবাড়ী ও খগাখড়িবাড়ী ইউনিয়ন। নদীতে বিলীন হয়ে গেছে শতাধিক ঘরবাড়ি।
খগাখড়িবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম লিথন বলেন, দোহলপাড়া বাঁধের ৬০ মিটার ভেঙে গেছে। এছাড়া ৪০টি পরিবারের জমি নদীতে চলে গেছে। এছাড়াও ভাঙনের মুখে পড়েছে আরো পাঁচটি পরিবার।
কুড়িগ্রাম : বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। সেতু পয়েন্টে ধরলার পানি সামান্য কমে বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ও চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ১৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কমেছে তিস্তাসহ অন্যান্য নদীর পানিও। এতে করে পানিবন্দি জীবনযাপন করছে অন্তত ৩০ হাজার মানুষ।
এদিকে বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে নদ-নদীর অববাহিকাসহ নিচু এলাকায় ১০ হাজার হেক্টর জমির রোপা আমন ও ৮৫ হেক্টর জমির সবজি ক্ষেত।
রোববার কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম জানান, উজানে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় ধরলা ও তিস্তার পানি কমতে শুরু করেছে।
মানিকগঞ্জ : হরিরামপুর উপজেলার চরাঞ্চলের আজিমনগর, সুতালরী ও লেছড়াগঞ্জ এ তিনটি ইউনিয়নে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের বসবাস। চরাঞ্চলের বৃহৎ এই জনগোষ্ঠীর একমাত্র চিকিৎসাকেন্দ্র ছিল আজিমনগর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র। কিন্তু প্রমত্ত পদ্মার ভয়াল থাবায় এটি এখন নদীতে চলে গেছে।
সস্প্রতি পদ্মা নদীতে পানি বৃদ্ধির কারণে তীব্র স্রোত ও ভাঙন শুরু হয়। এতে ভাঙনের কবলে পড়ে ওই চিকিৎসাকেন্দ্রটি। ভাঙন রোধে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার বলেও কোনো সুফল পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ করেন এলাকাবাসী।
জানা গেছে, শনিবার রাত ১১টার দিকে পদ্মার তীব্র স্রোতে ওই স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রটির ৭০ ভাগের বেশি অংশ নদীতে চলে যায়। পরে বাকি অংশটুকু রোববার সকালের দিকে নদীতে চলে গেছে। এতে তিনটি ইউনিয়নের প্রায় ৩০ হাজার মানুষের চিকিৎসাসেবা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছে এলাকাবাসী।
আজিমনগর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. বিল্লাল হোসেন বলেন, গেল বছর এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি নদী থেকে ১৫০ গজ দূরে ছিল। তখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানিয়েছি। ভাঙনের কবল থেকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিকে রক্ষা করতে এ বছরও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিতভাবে জানিয়েছি। তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জানিয়েছেন বলে আমাকে জানান। কিন্তু ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করতে পানি উন্নয়ন বোর্ড কোনো উদ্যোগই নেয়নি।
উল্লেখ্য, চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পদ্মায় বিলীন হয়েছে একই উপজেলার সুতালরী রামচন্দ্রপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এ ছাড়া চলতি বছর শতাধিক বাড়িঘর, বিস্তীর্ণ ফসলি জমি ইতোমধ্যে নদীতে চলে গেছে। ভাঙনের মুখে পড়েছে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান।
রাজবাড়ী : পদ্মা নদীর পানি দুটি পয়েন্টে কমলেও বেড়েছে একটি পয়েন্টে। ২৪ ঘণ্টায় দৌলতদিয়া পয়েন্টে পানি বেড়ে বিপদসীমার ৪৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া পাংশার সেনগ্রাম ও সদরের মাহেন্দ্রপুর পয়েন্টে ২৪ ঘণ্টায় পানি কমেছে। রোববার দুপুর ১২টায় পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) থেকে এ তথ্য জানা যায়।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় রাজবাড়ীর ৩টি গেজ স্টেশন পয়েন্টের মধ্যে গোয়ালন্দের দৌলতদিয়া পয়েন্টে পানি ১ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৪৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
অন্য দুটি পয়েন্টের মধ্যে পাংশার সেনগ্রাম পয়েন্টে ৫ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আর সদরের মাহেন্দ্রপুর পয়েন্টে পানি ১ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ১১ সেন্টিমিটার নিচে রয়েছে।
দৌলতদিয়া পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় লঞ্চঘাট ও ফেরিঘাটে ওঠার সংযোগ সড়ক তলিয়ে গেছে। এছাড়া নদীতে তীব্র স্রোত থাকায় ফেরি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়াও গোয়ালন্দ উপজেলার নদীতীরবর্তী অধিকাংশ অঞ্চল প্লাবিত হয়ে গেছে।
পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অন্তত ২ হাজার পরিবার। তলিয়ে গেছে গ্রামীণ অনেক রাস্তাঘাট। এতে করে সংশ্লিষ্ট এলাকার লোকজন চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। মাঠ-ঘাট তলিয়ে যাওয়ায় গো-খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে।
রংপুর : ভারি বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে তিস্তার পানি আবারো বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে রংপুরের ৩টি উপজেলার প্রায় ৩০টি চরাঞ্চলসহ নদীতীরবর্তী নিম্নাঞ্চলগুলো তৃতীয়বারের মতো প্লাবিত হয়ে পড়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে কয়েক হাজার পরিবার। পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নদীর উভয় তীরে ভয়াবহ ভাঙন শুরু হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, রোববার সকালে তিস্তার পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও গঙ্গাচড়া পয়েন্টে বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে কোলকোন্দ, আলমবিদিতর, গজঘণ্টা, নোহালী, কচুয়া ও মর্নেয়া ইউনিয়নের ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে পড়েছে। কোনো কোনো এলাকা দেড় থেকে আড়াই ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি অসংখ্য পরিবার অনাহারে-অর্ধাহারে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন।
লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের পশ্চিম ইচলি, শংকরদহ, বাগেরহাট আশ্রয়ন, পূর্ব ইচলির প্রায় ১ হাজার, নোহালীর মিনার বাজার, কচুয়াচর, বৈরাতী বাঁধের ধার, চর নোহালী, বাগডহরা চরের ৫শ, মর্নেয়া ইউনিয়নের মর্নেয়াচর, তালপট্টি, আলালচর, নরসিংচরের ৫শ, গজঘন্টা ইউনিয়নের কালির চর, ছালাপাক, গাউছিয়া বাজার, জয়দেব, মইশাসুর, রামদেব চরের প্রায় ৬ শতাধিকসহ আলমবিদিতর ও গঙ্গাচড়া ইউনিয়নের নিম্না এলাকার প্রায় ৬/৭শ’ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
রোববার সরেজমিনে এসব এলাকায় গেলে কেল্লার পাড়ের মহির উদ্দিন জানান, কষ্ট হলেও পানিবন্দি হয়ে থাকা যায়, কিন্তু বাড়ি ভেঙে গেলে তার মতো কষ্ট হয় না। তিনি ভাঙন রোধে জরুরি ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান।
পশ্চিম ইচলির বাবলু, আনোয়ার, জোবেদা বলেন, ৩ দিন ধরে পানিবন্দি অবস্থায় আছেন। উঁচু স্থানে কোনো রকম রান্না এবং আত্মীয়র দেয়া খাবার এক বেলা করে খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন। বিনবিনা চরের আইয়ুব ও মান্নান জানান, ভাঙন রোধে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে আরো বাড়ি ও জমি বিলীন হয়ে যাবে।
নয়া শতাব্দী/এম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ