ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

আতঙ্কের নাম কুকি-চিন

প্রকাশনার সময়: ১৮ মে ২০২৩, ০৯:৫৭

পার্বত্য এলাকা বান্দরবানের নতুন আতঙ্কের নাম বিচ্ছিন্নবাদী সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। অপহরণ-খুন-মুক্তিপণ আদায় এবং জঙ্গি প্রশিক্ষণের মতো গুরুতর অপরাধে তাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাচ্ছে। স্থানীয় অন্যান্য বিচ্ছন্নবাদী সংগঠনের সঙ্গেও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে অশান্ত পরিবেশ তৈরির উসকানিও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এমনকি তাদের হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না পার্বত্য এলাকার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা। খুন করা হচ্ছে বাহিনীর সদস্যদেরও।

সর্বশেষ মঙ্গলবার দুপুরে তাদের হামলায় মারা যান দুই সেনা সদস্য। আহত হন আরও দুই কর্মকর্তা। এমন পরিস্থিতিতে সাঁড়াশি অভিযানের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন স্থানীয় নিরিহ বাসিন্দারা। যদিও নতুন এই সংগঠনের দৈরাত্ম্য রুখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা কাজ করে যাচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

জানতে চাইলে র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফের বম সম্প্রদায়ের ২০০ সদস্য রয়েছে। প্রথমে তারা নিজেদের সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার জন্য সংগঠিত হওয়ার কথা বললেও পরে তারা জঙ্গি প্রশিক্ষণ, চাঁদাবাজিসহ নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তাদের এসব কার্যক্রম বান্দরবানের পর্যটন ও অর্থনীতির জন্য হুমকি। এরপর গত অক্টোবর থেকে পাহাড়ে হিন্দাল শারক্বীয়ার জঙ্গি ও বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে কেএনএফ সন্ত্রাসীরা পাহাড়ের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে নানা অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে কয়েক দফায় পাহাড়ে অভিযান চালানো হয়েছে। কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। নাথান বমসহ সংগঠনের শীর্ষ নেতারা গা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন। তাদের ঘিরেও র‍্যাবের নজরদারি রয়েছে। যারাই দেশের বিরুদ্ধে বা আইনের বিরুদ্ধে কাজ করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

জানা গেছে, উঁচু পাহাড়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের জন্য বান্দরবান ঘিরে পর্যটকদের আগ্রহের শেষ নেই। মেঘে ঘেরা পাহাড়ি এ অঞ্চলে রাস্তাঘাট ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের কারণে থানচি, রুমা ও রোয়াংছড়ির মতো দুর্গম অঞ্চলেও নতুন নতুন পাহাড়ি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠতে শুরু করেছে। কিন্তু সম্প্রতি পার্বত্য অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) অশান্ত-ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করায় এসব উদ্যোগ ম্লান হতে বসেছে। আধিপত্য বিস্তারে বর্তমানে তারা পাহাড়ে সরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডগুলোতেও নানাভাবে বাধা সৃষ্টি করছে। ঘটছে প্রাণহাণির ঘটনাও। ভীতিকর এমন পরিস্থিতিতে বান্দরবানের পর্যটন সম্ভাবনা চরম ঝুঁকিতে রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

সূত্রমতে, কেএনএফ মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানকেন্দ্রিক আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠন। পার্বত্য তিন জেলার প্রায় অর্ধেক আয়তনের লামা, রুমা, আলীকদম, থানচি, রোয়াংছড়ি, বিলাইছড়ি, জুরাইছড়ি ও বরকলসহ আশপাশের এলাকা নিয়ে একটি মনগড়া মানচিত্র তৈরি করেছে কেএনএফ। প্রস্তাবিত মানচিত্রের তিন দিকে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্ত। পাহাড়ের বম, পাঙ্খুয়া, খুমি, ম্রো এবং খিয়াং নামক ক্ষুদ্র ছয়টি জাতি-গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠন হয়েছে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ।

সংগঠনের লোগোতে প্রতিষ্ঠাকাল ২০০৮ সাল বলে উল্লেখ থাকলেও মূলত ২০১৮ সালের পর থেকে সশস্ত্র কাঠামোয় মাথাচাড়া দিতে থাকে সংগঠনটি। সবশেষ গত বছরের অক্টোবর মাস থেকে কুকিদের ভয়ংকর রূপ জনসমক্ষে আসে। এ সংগঠনের সদস্যরা বান্দরবানের থানচি সড়ক নির্মানের কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করতে গত ১১ মার্চ ১২ শ্রমিককে অপহরণ করে। তাদের মধ্যে একজন শ্রমিক গুলিবিদ্ধ হয়। এ ছাড়া সাত শ্রমিককে মুক্তিপণের বিনিময়ে ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সড়ক নির্মাণ কাজে আর না যাওয়ার শর্তে ছেড়ে দেয়। বাকি চার শ্রমিককে এখনও কেএনএ জিম্মি করে রেখেছে বলে জানা যায়।

তারই ধারাবাহিকতায় পরের দিন গত ১২ মার্চ দুপুরে বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে অতর্কিতে গুলিবর্ষণ করে টহলরত সেনাবাহিনীর এক সদস্যকে (মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার নাজিম উদ্দিন) হত্যা এবং দুজনকে আহত করে কুকি সন্ত্রাসীরা। তার আগে গত ৮ ফেব্রুয়ারি বান্দরবানের ৩ উপজেলায় ‘কেএনএ’ গাড়ি চলাচল বন্ধের জন্য পরিবহন মালিক সমিতিকে হুমকি দিয়ে নোটিশ জারি করে। যার মূল উদ্দেশ্য বান্দরবানকে পর্যটকশূন্য করা। সবশেষ গতকাল বুধবার সেনাবাহিনীর টহল দলের সদস্যদের ওপর হামলা চালিয়ে ২ সেনা সদস্যকে খুন করেন। গুরুতর আহত অবস্থায় আরও দুই কর্মকর্তাকে চট্টগ্রাম সিএমএইচ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে।

সূত্রমতে, কেএনএফের বিষয়ে কথা বলতে চান না স্থানীয়রা। তবে নাম না প্রকাশের শর্তে কয়েকজন জানান, তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে তুলনামূলক শান্তপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করছিল। রাস্তাঘাট ও অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়নের কারণে থানচি, রুমা ও রোয়াংছড়ির মতো দুর্গম অঞ্চলেও নতুন নতুন পাহাড়ি পর্যটন মাত্রই জমে উঠা শুরু হয়েছে। ঠিক তখনই বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠী কেএনএফ অশান্ত-ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে বান্দরবান তথা পার্বত্য অঞ্চলে। জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়াকে অস্ত্র প্রশিক্ষণসহ সার্বিক মদদ দেয়া এই কেএনএফ এখন পাহাড়ের শান্তি-শৃঙ্খলার জন্য প্রধান হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আধিপত্য বা শক্তি-সামর্থ্য দেখাতে বর্তমানে তারা পাহাড়ে সরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডগুলোতেও নানাভাবে বাধা সৃষ্টি করছে। কথা মতো না চললে নিজ সম্প্রদায় বা অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বাসিন্দাদেরও রেহাই দিচ্ছে না তারা। প্রায়ই এ সম্প্রদায়ের লোকজনের মরদেহ উদ্ধার করা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে ওই সংগঠনের কথা না শোনার কারণে তাদের হত্যা করেছে কুকি চিনের সদস্যরা। বান্দরবান দুর্নীতি কমিশনের জেলা সভাপতি অচমং মারমা বলেন, ‘পাহাড়ে শান্তি ফেরাতে সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। পাহাড়ে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরির পেছনে মূলত কেএনএফসহ বেশ কয়েকটি বিচ্ছিন্নতাবাধী গোষ্ঠীর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। বান্দরবাদের পর্যটন ও অর্থনীতির বিকাশের জন্য সবার আগে পাহাড়ে শান্তি ফেরাতে হবে। যেভাবে দক্ষিণ অঞ্চল থেকে আলোচনার মাধ্যমে সর্বহারা সমস্যার সমাধান হয়েছে। এখানেও সেভাবেই আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান করতে হবে।’

সূত্রমতে, কুকি চিন ছাড়াও তিন পার্বত্য এলাকায় সক্রিয় রয়েছে আরও পাঁচটি গ্রুপ। তারাও নানাভাবে নির্যাতন করে আসছে স্থানীয়দের। গ্রুপগুলো হচ্ছে— পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (সন্তু লারমা গ্রুপ), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ- প্রসিত গ্রুপ), পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (লারমা সংস্কার গ্রুপ), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ-সংস্কার গ্রুপ) ও মগ লিবারেল ফ্রন্ট। তাদের সদস্যরা প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করেন। আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে এসব গ্রুপের মধ্যে পাল্টাপাল্টি খুন যেন হয়েছে নিত্য ঘটনা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, এসব পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের রয়েছে বিভিন্ন ধরনের পদবি। তারা একস্থানে বেশিদিন দায়িত্ব পালন করে না। বিভিন্ন এলাকায় তাদের পোস্টিং দেয়া হয়। সেসব এলাকা থেকে চাঁদাবাজি করে তাদের মূল নেতার কাছে পৌঁছানোই তাদের একমাত্র কাজ। ওইসব এলাকায় অন্য কোনো বাহিনীর অস্বিত্ব থাকলে তাদের দলে ভেড়ানো না হলে খুন করারই একমাত্র লক্ষ্য থাকে বলে স্থানীয়রা দাবি করেন।

গত ২০২১ সালের ২৯ ডিসেম্বর দিনদুপুরে বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এবং ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) সশস্ত্র সদস্যরা। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে দুজন প্রাণ হারান। ঘটনার দিন দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বাঘাইছড়ি উপজেলার দুই কিলো নামক স্থানে এ ঘটনা ঘটে। জেএসএস ও ইউপিডিএফের একাংশ পাহাড়ে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হয়। উভয় গ্রুপের মধ্যে কয়েক ঘণ্টা ধরে বন্দুকযুদ্ধ চলে। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান জেএসএসের সদস্য জানন চাকমা ও ইউপিডিএফের সদস্য মনিময় চাকমা। ঘটনার সময় গুলিবিদ্ধ হন মনু মিয়া নামে এক শ্রমিক। এ নিয়ে ওই বছর ডিসেম্বরেই রাঙামাটি জেলার তিন উপজেলায় ছয়জন নিহত হন। সব মিলিয়ে ওই বছরই মারা যান ১৭ জন।

স্থানীয়দের দাবি— অস্থিরতার কারণে পাহাড়ে দিনে দিনে আঞ্চলিক সংগঠনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন দল ছেড়ে নতুন নতুন দল-উপদল তৈরির মাধ্যমে সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। পাহাড়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা নিয়ে আঞ্চলিক দলগুলোও পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করছে। তারা একে অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে প্রতিনিয়ত হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত হচ্ছে। আঞ্চলিক দলগুলো তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম ধামাচাপা দিতে লাশ গুম করে ফেলছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। জনসংহতি সমিতি (সন্তু গ্রুপ) ও ইউপিডিএফের (প্রসিত গ্রুপ) মধ্যে অস্ত্রবিরতি চুক্তি থাকলেও সম্প্রতি এই চুক্তি কেউ মানছে না বলে জানিয়েছেন আঞ্চলিক নেতারা।

সূত্রমতে, সব এলাকাই কমবেশি ৫ গ্রুপের অস্বিত্ব রয়েছে। এ কারণে কে কার লোক এটা বোঝা মুশকিল হয়ে পড়ে। রাত হলেই তাদের আসল পরিচয় বেরিয়ে আসে।

অজ্ঞাত নম্বর থেকে ব্যবসায়ী ও স্থানীয়দের কাছে গ্রুপের নামে চাঁদা চাওয়া হয়। কোনো কারণে তাদের নির্দেশ অমান্য করলেই শাস্তি নির্ধারণ হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে পাহাড়ে যাওয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে জুমচাষিরা বিপাকে পড়েন। এ কারণে সন্তাসী গোষ্ঠীদের চাহিদা মিটিয়েই সবাই বসবাস করেন।

নয়াশতাব্দী/জেডএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ