করোনাভাইরাসের টিকার জন্য রেজিস্ট্রেশন করে এসএমএস বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। নিবন্ধন করার এক মাস পার হয়ে গেলেও মেসেজ পাচ্ছেন না অনেকেই।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, দেশে এখন পর্যন্ত প্রায় এক কোটি ৯০ লাখের মতো মানুষ টিকার জন্য অপেক্ষায় রয়েছেন। টিকা নিতে এই বিপুল পরিমাণ মানুষ নিবন্ধন করলেও এখনো প্রথম ডোজ টিকার জন্যই কোনো মেসেজ পাননি তারা। তাদের মধ্যে কেউ কেউ একমাসের বেশি আগে নিবন্ধন করলেও এখনো স্বাস্থ্য অধিদফতরের কোনো বার্তা পাননি। ফলে টিকা নেয়া নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।
অনেকেই অভিযোগ করে বলছেন, নিবন্ধনের পর দিনের পর দিন অপেক্ষা করেও টিকা পাচ্ছেন না। মুঠোফোনে এসএমএসের মাধ্যমে টিকা দেয়ার তারিখ এখনো জানানো হয়নি। আবার অনেকে দ্বিতীয়বার নিবন্ধনের চেষ্টা করেছেন। একবার হয়ে যাওয়ায় আর নিবন্ধন করতে পারছেন না। তবে বাংলাদেশে যে বিপুলসংখ্যক মানুষ টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন তাদের আরো কতদিন অপেক্ষা করতে হবে তা স্পষ্ট করেননি কেউই।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মোট নিবন্ধন করেছেন তিন কোটি ৬৫ লাখের বেশি মানুষ। এদের মধ্যে এক ডোজ টিকা নিয়েছেন এক কোটি ৭৫ লাখ। আর দুই ডোজই সম্পন্ন করেছেন ৭২ লাখের মতো মানুষ। অর্থাৎ এখনো টিকা এক ডোজ পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন প্রায় এক কোটি ৯০ লাখ মানুষ। নিবন্ধন করে টিকার জন্য অপেক্ষায় থাকা মানুষের বিপরীতে সরকারের কাছে সিনোফার্ম ও মডার্না মিলিয়ে টিকার মজুদ রয়েছে ৬৫ লাখ ৩৬ হাজারের কিছু বেশি। চাহিদার তুলনায় সরকারের হাতে টিকার মজুদ কম থাকায় সেই তালিকা ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে।চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা এলাকার বাসিন্দা ফ্যান্সি দত্ত পেশায় একজন স্কুলশিক্ষিকা। গত ৩০ জুলাই টিকা নেয়ার নিবন্ধন করেন। পরিবারের আরো ৪ সদস্য নিবন্ধন করে। তবে প্রায় মাসখানেক পেরিয়ে গেলেও এখনো তিনি বা তার পরিবারের কেউ টিকা নেয়ার জন্য কোনো এসএমএস পাননি। আমার পরেও কতজন নাম নিবন্ধন করে টিকা পেল। কিন্তু আমার তো এখনো মেসেজই এলো না। তিনি বলেন, তার আরো কয়েকজন সহকর্মীও টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন। তাদেরও তারই মতো অবস্থা। তারা কেউই এখনো এসএমএস পাননি। স্কুল খুলে দেয়ার কথা শোনা যাচ্ছে তাহলে তো আবার বিপদে পড়ে যাব।
টিকার জন্য বিদেশে যেতে পারছেন না কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার প্রবাসী বাহাউদ্দিন আহমেদ দিপু। তিনি বলেন, টিকার জন্য বাংলাদেশে আটকে আছি। সম্প্রতি ছুটিতে দেশে ফিরেছেন। ছুটি শেষে সিঙ্গাপুর থাকা তার নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান তাকে ফিরে যেতে বললেও টিকা না পাওয়ার কারণে যেতে পারছেন না তিনি।
তিনি বলেন, চলতি মাসের ১০ তারিখে টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন। কিন্তু প্রথম ডোজের জন্য এখনো কোনো মেসেজে পাননি। পরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগাযোগ করেছিলাম। কিন্তু তারা বলেছে যে, এসএমএস না এলে কিছু করা যাবে না। ২৫ দিন অপেক্ষা করতে বলেছে।
টিকার প্রথম বা দ্বিতীয় ডোজের জন্য তারিখ জানিয়ে এসএমএস পাঠানো হয়ে থাকে নিবন্ধনের সময় উল্লেখ করা টিকা কেন্দ্র থেকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যারা আগে নিবন্ধন করেছেন এবং যাদের বয়স ৬০ বছরের বেশি এসএমএস ও টিকা দেয়ার ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। সবসময় এই সিরিয়াল অনুসরণ করা সম্ভব হয় না।
কারণ বিভিন্ন সুপারিশে অনেকের টিকা নেয়ার তারিখ এগিয়ে নিয়ে আসা হয়ে থাকে। হাতেকলমে এসএমএস পাঠানোর এই পদ্ধতিতে যদি কারো নাম একবার বাদ পড়ে যায়, তাহলে সেটি টের পাওয়ার সহজ উপায় নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মুখপাত্র ও শ্যামলী ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডা. আয়শা আক্তার বলেন, বয়সসীমা কমিয়ে দেয়ায় বিপুলসংখ্যক মানুষ টিকার জন্য নিবন্ধন করছে। যার কারণে কেন্দ্রগুলোতে অনেক বেশি নিবন্ধনকারীর সংখ্যা জমে যাচ্ছে। যে কেন্দ্রে টিকার জন্য নিবন্ধন করা হয় সেখানে নিবন্ধনের আইডি নম্বরটা থেকে যায়। ওই নম্বর অনুযায়ী, যে আগে নিবন্ধন করবে তাকে আগে এসএমএস পাঠানো হয়। প্রবাসীদেরও অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখা হয়। তবে যারা বিদেশে যেতে চান অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার ক্ষেত্রে তাদের হাতে আট সপ্তাহ সময় আছে কিনা সেটি খেয়াল রাখতে হবে।
তিনি আরো বলেন, নিবন্ধনের তুলনায় টিকার পরিমাণ কম থাকার কারণে বেশি মানুষকে একসঙ্গে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এক কেন্দ্রে টিকা দেয়ার সক্ষমতা আছে ৫০০, কিন্তু প্রতিদিন নিবন্ধনই করে ৫-৭ হাজার মানুষ। ফলে বাকিগুলো জমতে থাকে। অনেক বড় কেন্দ্রে এখনো ৫০-৬০ হাজার জমে রয়েছে। জনবল এবং টিকা দেয়ার সক্ষমতা কম থাকায় অনেক সময় একটি কেন্দ্রে নিবন্ধনকারীর সংখ্যাও জমে যায়। ফলে এসএমএস পেতেও দেরি হয়।
টিকার স্বল্পতার কথা জানিয়ে টিকা বিষয়ক জাতীয় কমিটির সদস্য ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, এক সঙ্গে এক-দেড় কোটি মানুষকে টিকা দিয়ে দেয়ার মতো মজুদ এই মুহূর্তে আমাদের হাতে নেই। তবে পর্যাপ্ত মজুদ না থাকলেও টিকা ক্রমান্বয়ে আসছে। নিবন্ধন করা থাকলে টিকা নিয়ে পরিকল্পনা করা সহজ হয়। যারা আগে নিবন্ধন করবেন তারাই টিকা পাবেন আগে।
তিনি বলেন, যত মানুষ রেজিস্ট্রেশন করেছে তত টিকা হাতে নেই, তবে টিকা আসছে। সিনোফার্মের টিকা রেগুলার আসছে। সঙ্গে কোভ্যাক্স থেকেও টিকা আসছে। এছাড়া আগামী সপ্তাহে ফাইজারের ১০ লাখ ডোজ, সেপ্টেম্বরে ফাইজারের আরো ৫০ লাখ এবং ২৩ সেপ্টেম্বরে সিনোফার্মের আরো টিকা আসবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের এমএনসিএইচ বিভাগের পরিচালক ডা. মো. শামসুল হক বলেন, টিকা দেয়ার চেয়ে নিবন্ধন দ্রুতগতিতে চলছে। এই কারণে তালিকাও লম্বা হচ্ছে। যারা টিকা নেয়ার জন্য নিবন্ধন করেছেন, পর্যায়ক্রমে সবাই পাবেন। মেসেজ না এলে একটু অপেক্ষা করতে হবে। কারো যদি দুইমাস বা তার বেশি অপেক্ষা করতে হয় তাহলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের এমআইএস শাখায় যোগাযোগ করার পরার্মশ দেন তিনি।
অন্যদিকে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পর্যাপ্ত টিকা হাতে না পেয়ে গণটিকার কার্যক্রম শুরু করাটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। তারা বলছেন, গণটিকা না দিয়ে যদি ওই সময়ে যারা নিবন্ধন করেছে তাদের টিকা দিয়ে দেয়া হতো তাহলে এত মানুষকে এখন অপেক্ষা করতে হতো না।
জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বে-নজীর আহমেদ বলেন, নিবন্ধন এবং টিকার মজুদের মধ্যে যে অসামঞ্জস্যতা রয়েছে সেটি কাটিয়ে উঠতে হলে পর্যাপ্ত টিকা হাতে না আসা পর্যন্ত গণটিকার কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হবে। সেই সঙ্গে সরকারের হাতে এখন যে টিকা আছে এবং যত টিকা পাইপলাইনে আছে সেগুলো মিলিয়ে একটি পরিকল্পনা অনুযায়ী সামনে আগাতে হবে। যারা নিবন্ধন করেছেন, তাদের দুটি ডোজ টিকাই কত দিনের মধ্যে শেষ করা যাবে।
তিনি বলেন, একই সঙ্গে যেসব মানুষ নিবন্ধন করেননি কিন্তু বয়স বেশি এবং অন্য স্বাস্থ্য সমস্যা বা কো-মরবিডিটি আছে তাদের এর আওতায় আনতে হবে।
নয়া শতাব্দী/এম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ