রাজধানীসহ দেশজুড়ে গড়ে উঠেছে সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র। এই চক্রের সদস্যরা অভিনব পন্থায় হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। তাদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও। অভিযোগ রয়েছে সরকারি দফতরের নথি জাল করে চাকরি, ব্যাংকের এটিএম বুথের জার্নাল পরিবর্তন ও ব্যবসায় বিনিয়োগের কথা বলেও প্রতারক চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। জনপ্রতিনিধিরাও রক্ষা পাচ্ছে না এই চক্রের হাত থেকে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের অভিযানে গত কয়েক মাসে অন্তত শতাধিক প্রতারক ধরা পড়লেও বেছে নেয়া হচ্ছে নতুন নতুন পন্থা। এমন পরিস্থিতিতে এসব প্রতারক চক্রকে গ্রেফতারে আঁটঘাট বেঁধে মাঠে নেমেছে পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল বিভাগের সোশ্যাল মিডিয়া ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম। কাজ করে যাচ্ছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনসহ পুলিশের একাধিক ইউনিটের সদস্যরা।
সর্বশেষ ২৫ আগস্ট বুধবার ইমো নাম্বার হ্যাক করে অর্থ আদায়ের অভিযোগে মো. পলাশ আলী ও মো. সাব্বির হোসেন নামের দুই হ্যাকারকে গ্রেফতার করে ডিবির সোশ্যাল মিডিয়া ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম। এদের মধ্যে পলাশ বিএসসি টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে অধ্যয়নরত। তারা ২০১৮ সাল থেকে ইমো নাম্বার হ্যাক করে অর্থ আদায় করে আসছিল বলে ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন। একইদিন জনপ্রতিনিধির কাছ থেকে চাকরি দেয়ার নাম করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে নরসিংদী থেকে দুইজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
এ বিষয়ে ডিবির সোশ্যাল মিডিয়া ক্রাইম ইনভেস্টিগেশনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার জুনায়েদ আলম সরকার নয়া শতাব্দীকে বলেন, গ্রেফতারকৃতরা তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞান সম্পর্কে পারদর্শী। এদের মধ্যে সাব্বির প্রবাসী বাংলাদেশিদের মোবাইল নাম্বার কৌশলে সংগ্রহ করে মো. পলাশ আলীকে দেয়। এরপর পলাশ
বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তির নাম্বারে একটি ওটিপি কোড পাঠায় এবং কৌশলে তার কাছ থেকে ওটিপি কোড জেনে ইমো আইডির নিয়ন্ত্রণ নেয়। এরপর ওই নাম্বার থেকে দেশে অবস্থানরত প্রবাসীর আত্মীয়স্বজনের কাছে ফোন করে বিপদের কথা বলে টাকা হাওলাত চায়। এতে অনেকেই তাদের টাকা পাঠিয়ে দেয়। পরে যখন বুঝতে পারে নাম্বার হ্যাক হয়েছে ততক্ষণ টাকা চলে যায় প্রতারকদের হাতে। এ ঘটনায় সম্প্রতি মো. জাকির হোসেন নামে এক ভুক্তভোগী পল্টন থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় তাদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা এরই মাঝে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নেন।
তিনি বলেন, ইমো থেকে কখনো ওটিপি কোড এলে উক্ত কোডটি অন্যের কাছে শেয়ার করা থেকে বিরত থাকলেই এ ধরনের প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। একই সঙ্গে ইমোতে বিপদের কথা বলে টাকা চাইলে যাচাই-বাচাই না করে টাকা দেয়া থেকে বিরত থাকারও পরামর্শ দেন ডিবির এই কর্মকর্তা।
এর আগে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এটিএমের ইলেকট্রনিক জার্নাল পরিবর্তন করে ৬৩৭টি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ১৩৬৩টি লেনদেন করে দুই কোটি সাতান্ন লাখ এক হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগে চার সদস্যকে গ্রেফতার করে ডিবির একই টিম। এ ঘটনায় ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. মশিউর রহমান বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় চলতি বছরের ১৬ জুন ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে সায়মা আক্তার, আল-আমিন বাবু, মেহেদী হাসান ওরফে মামুন ও আসাদুজ্জামান আসাদকে গ্রেফতার করা হয়। এ ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী ব্যাংকটির সিনিয়র অফিসার মীর মো. শাহারুজ্জামান ওরফে রনি। তিনি ওই ব্যাংকে কর্মরত থাকা অবস্থায় স্ত্রীসহ গ্রেফতারকৃত সহযোগীদের দিয়ে এটিএম বুথে লেনদেন করাতেন এবং লেনদেনের পর এটিএমের ইলেকট্রনিক জার্নাল পরিবর্তন করে দিতেন। ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এটিএম মনিটরিং রোস্টার টিমে কর্মরত থাকা অবস্থায় তিনি এই অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন।
এরপর তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে তৎপর রয়েছে গোয়েন্দারা। এর আগে ২৫ মে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব পরিচয়ে প্রতারণা করার অভিযোগে সোহেল ইসলাম রানা ও শাকিল ইসলাম নামে দুজনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এ সময় তাদের কাছ থেকে প্রতারণার কাজে ছয়টি মোবাইল ফোন ও ১১টি সিম কার্ড উদ্ধার করা হয়।
জানা গেছে, কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. হাসানুজ্জামান কল্লোলের কার্যালয়ের অফিস সহায়ক মো. মোস্তাফিজুর রহমানের পরিচয় দিয়ে জামালপুর জেলার উপ-পরিচালক জাকিয়া সুলতানাকে গত ১২ মে ফোন করেন গ্রেফতার শাকিল। তাকে বলা হয় কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাকের শ্যালিকার এখনই ২৫ হাজার টাকা প্রয়োজন। তাকে যেন তিনি (জাকিয়া সুলতানা) ২৫ হাজার টাকা ওই নাম্বারের নগদ অ্যাকাউন্টে পাঠান। বিষয়টি সন্দেহজনক মনে হওয়ায় অতিরিক্ত সচিব মো. হাসানুজ্জামান কল্লোলকে বিস্তারিত জানান জাকিয়া সুলতানা।
পরে একই পরিচয়ে শেরপুর জেলার উপ-পরিচালক ড. মোহিত কুমার দে ও ময়মনসিংহ জেলার উপ-পরিচালক ড. মো. রেজাউল করিমের কাছেও ফোন করা হয়। তাদের কাছেও একইভাবে ২৫ হাজার টাকা চাওয়া হয়। তাদের কাছেও বিষয়টি সন্দেহ হওয়ায় তারাও বিষয়টি কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে জানান। পরে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের কার্যালয়ের অফিস সহায়ক মো. মোস্তাফিজুর রহমান বাদী হয়ে রাজধানীর ভাটারা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় তাদের গ্রেফতার করা হয়।
এ ঘটনার আগে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি চৌধুরী গ্রুপের নাম ভাঙিয়ে ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে আশিক চৌধুরী নামে এক যুবককে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ ঘটনায় চোধুরী গ্রুপ অব কোম্পানির স্টেট ম্যানেজার আমিরুল ইসলাম হাতিরঝিল থানায় একটি ডিজিটাল মামলা করেন। ওই মামলায় আশিককে গ্রেফতারের পর দেখা যায় বিভিন্নজনকে ভুয়া নিয়োগপত্রে মাসিক ৯২ হাজার টাকা বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে তিনি কোটি টাকা আত্মসাত করেন। একই সঙ্গে সুন্দরী মহিলাদের তার কোম্পানির মডেল হওয়ার জন্য অফার করে আসছিল। সে নিজেকে বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা এবং ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি হিসেবে দাবি করেন।
এদিকে চাকরি দেয়ার নাম করে শতাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে গত ২৫ আগস্ট মো. জাকির হোসেন ও মো. মাজাহারুল নামের দুইজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) গ্রেফতারকৃতদের নামে নরসিংদীর শিবপুর থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।
পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু ইউসুফ জানান, গ্রেফতারকৃতরা নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহÑ এ চারটি জেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের ওয়ার্ড মেম্বারদের কাছে গ্রামের উন্নয়নমূলক কাজের জন্য বিভিন্ন লোকবল নিয়োগ দেয়ার কথা বলে। বিশেষ করে তারা মহিলা ওয়ার্ড মেম্বারদের টার্গেট করত।
এরপর মেম্বাররা স্থানীয় লোকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে প্রতারক চক্রটিকে বিকাশ, রকেট বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাঠাত। নরসিংদী জেলার শিবপুর থানার পুটিয়া ইউনিয়নের ০৯নং ওয়ার্ডের মহিলা মেম্বার মোসাম্মৎ আফিয়া বেগম সেই প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়েন। তিনি গ্রামের প্রায় ৩৫ জনের কাছ থেকে অফিস সিকিউরিটি হিসেবে প্রায় তিন লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা ও অন্যান্য অফিসের চাকরির কথা বলে মোট ছয় লাখ নব্বই হাজার টাকা সংগ্রহ করে প্রতারক চক্রটিকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রদান করেন।
এর আগে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি নাসরিন খানম নামে এক ব্যাংকারের অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিকাশ প্রতারক চক্রের প্রধানসহ ৩ জনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট। গ্রেফতারকৃত মো. হাফিজুল ইসলাম, মো. সাদ্দাম হোসেন ও মো. তুহিন মাহমুদ কাস্টমার কেয়ার থেকে ফোন করার কথা বলে কৌশলে বিকাশের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়ে আসছিল। একই মাসে নাসরিন পারভীন নামে এক নারীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে অনলাইন মার্কেটে প্রতারণার কারণে এক তরুণীসহ ৩ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছেন, খালিদ শামস প্রান্ত, সুইটি আক্তার মিম ও মো. মিরাজ তালুকদার।
গ্রেফতারকৃতরা গুলমহর নামে ফেসবুক পেজ ব্যবহার করে বিভিন্ন শাড়ি, থ্রিপিস ও অন্যান্য পণ্য বিক্রয়ের জন্য বিজ্ঞাপন দিয়ে আসছিল। সেখানে ৪ হাজার টাকায় একটি শাড়ি অর্ডার করার পর ডেলিভারির সময় দেখা যায় সেটি পুরনো একটি লাল শাড়ি। এরপর তারা ভুক্তভোগী নাসরিনের নাম্বার ব্লক করে দেয়। পরে তাদের খুলনার বয়রা এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। তারা তিনটি আইডি ব্যবহার করে এ ধরনের কর্মকা- করে আসছিল বলে স্বীকার করেন। এরপর তাদের নামে আরো একাধিক ব্যক্তি অভিযোগ করেন।
নয়া শতাব্দী/এসইউ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ