রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ সঠিকপথেই আছে। তবে মিয়ানমারের নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখলের পর প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া জটিল হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন কূটনীতিক ও বিশেষজ্ঞরা। রোহিঙ্গা সংকটের ৪ বছর পূর্তির প্রেক্ষাপটে এমন মতামত জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে বড় আকারে রোহিঙ্গাপীড়নের পর চার বছর পার হলেও বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে কোনো ভূমিকাই রাখেনি মিয়ানমার। উল্টো দেশটির অনীহার কারণে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নেয়া পদক্ষেপগুলো ব্যর্থ হয়েছে।
জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুকে সহজভাবে দেখার সুযোগ নেই। আবার প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে স্থবিরও বলা যাবে না। এটা আন্তর্জাতিক সমস্যা, যে কারণে এখানে অনেকপক্ষের চাওয়ার সমন্বয় করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশই প্রথম এই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে বিষয়টা এমন নয়। আবার এটা দুই-চার বছরে সমাধান করা সম্ভব তাও কিন্তু নয়। ফিলিস্তিনের এই সমস্যা ১৯৪৮ সাল থেকে, প্রায় ৭৩ বছর। তবে এই সমস্যা সমাধানে লেগে থাকতে হবে। এখানে অনেকের চাওয়ার সমন্বয় থাকতে হবে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরাতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রক্রিয়া সঠিকপথে আছে কিনা প্রশ্নে ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রক্রিয়া যথাযথই আছে। আমরা চার বছরে কিছু জায়গায় বেশ সফল। যেমন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এটা নিয়ে নিয়মিত কথা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা হয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির আন্তর্জাতিক পুরস্কার কেড়ে নেয়া হয়েছে। এভাবে গত চার বছরে মিয়ানমারের ওপর অনেক চাপ তৈরি হয়েছে। যদিও এসব বিষয় মিয়ানমার গায়ে না মাখার কারণে বাংলাদেশের করণীয় কঠিন হয়ে গেছে। এরপরও বলতে হবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ ঠিকপথেই এগোচ্ছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এই বিশ্লেষক আরো বলেন, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিষয়টা গুরুত্ব পাচ্ছে। কিন্তু ভারত ও চীন তেমনভাবে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করছে না। এ দু’দেশের সহযোগিতা পেলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নেয়া পদক্ষেপগুলো আরো সহজ হয়ে যেত। অবশ্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে এই দুটি দেশকে বাংলাদেশের বলার আরো সুযোগ আছে।
বাংলাদেশের করণীয় আর কী হতে পারে জানতে চাইলে ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, বিষয়টি নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচার করতে হবে। সুশীল সমাজকে আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে। পাশাপাশি জাতিসংঘে বিষয়টা উত্থাপন অব্যাহত রাখতে হবে। এই প্রক্রিয়া ছাড়া প্রত্যাবাসনের আর কোনো শর্টকাট পথ নেই।
তিনি বলেন, মিয়ানমারের জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে নেতৃত্বে থাকা বামার বাদে বাকি ১৩৪টি জাতিগোষ্ঠীই এক অর্থে জিম্মি। আবার সেনা শাসকদের কাছে বামাররা জিম্মি। এই অবস্থায় সেখানে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের বর্তমান সেনা শাসকদের কাছে অনেক দূরের বিষয়। তাহলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া কি মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে এমন প্রশ্নে ড. দেলোয়ার বলেন, সমস্যার মাত্র চার বছরে এমন প্রশ্ন না আসাই ভালো। এত তাড়াতাড়ি হতাশ হয়ে পড়লে হবে না। প্রত্যাবাসনের ইতিহাসই এমন এটা কোনো একপক্ষীয় বিষয় না। মূলত, বাংলাদেশ যেটা চাইছে মিয়ানমার সেটা চাইছে না। তারা বারবার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করছে। সেনা শাসক আসার পর বিষয়টি আরো জটিল হয়ে পড়েছে।
এদিকে, বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাই কমিশনার রবার্ট চ্যাটার্টন ডিকসন বলেছেন, আমি যতবার কক্সবাজার যাই, ততবারই রোহিঙ্গা জনগণের অসাধারণ সহিষ্ণুতা ও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয়দানকারী স্থানীয় জনগণের উদারতায় অত্যন্ত মুগ্ধ হই ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। তিনি বলেন, ২০১৭ সালের আগস্টের ভয়াবহ সহিংসতার চার বছর এবং আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার ঐতিহাসিক মামলা করার প্রায় দুই বছর পর মিয়ানমারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন বা সেখানে তাদের নিরাপত্তা ও নাগরিকত্বের নিশ্চয়তার ব্যাপারে সামান্যই অগ্রগতি হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান ও এরপর সংঘটিত সহিংসতার পর সহসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা আরো চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে মিয়ানমারে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের অবস্থা আরো অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
এই ব্রিটিশ কূটনীতিক আরো বলেন, বাংলাদেশ সরকার ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে কক্সবাজারে মানবিক কার্যক্রম লাখো মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। ২০১৭ সাল থেকে এই সংকট ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হয়েছে এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীরা জরুরি খাদ্য, আশ্রয়, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের সুবিধা পেয়েছে। এই মানবিক সংকট থেকে উত্তরণে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা ও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয়দানকারী স্থানীয় জনগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
তিনি বলেন, চলমান রোহিঙ্গা সংকট সংশ্লিষ্ট সবার জন্য একটি ট্র্যাজেডি। পৃথিবীর কেউই শরণার্থী শিবিরে স্বেচ্ছায় থাকতে চান না। বাস্তুচ্যুত অনেক মানুষকে একসঙ্গে কেউ আশ্রয়ও দিতে চায় না। বিশ্বব্যাপী অন্য অনেক শরণার্থীর মতো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সিংহভাগ নিজ দেশে ফিরতে চায়। তিনি বলেন, যেহেতু রোহিঙ্গা শরণার্থীরা খুব শিগগির নিজ দেশে ফিরতে পারছে না, তাই স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসনের আগ পর্যন্ত কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগণের জন্য মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখা অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে আমরা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। তাই, জাতিসংঘের জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানের অধীনে সম্প্রতি আমরা নতুন অর্থায়ন ঘোষণা করেছি। আমি যেমনটি দেখেছি, রোহিঙ্গাদের জন্য ভাসানচরে নির্মিত সুন্দর আবাসন প্রকল্প কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে জনসংখ্যার চাপ কমাতে সাহায্য করতে পারে। আমরা সেখানে জাতিসংঘের উপস্থিতি দেখার কথাও ভাবছি। কিন্তু আমাদের এটাও বুঝতে হবে যে, কক্সবাজারে শরণার্থী শিবিরে বিশাল সংখ্যায় রোহিঙ্গার উপস্থিতি থাকবে এবং একই সঙ্গে এই জায়গাটি মানবিক কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবেই থেকে যাবে। অতএব, রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যেখানেই থাকুক না কেন তাদের একইভাবে সহায়তা করা উচিত।
নয়া শতাব্দী/এসইউ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ