ঢাকা, রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

আরাভের ‘আয়নাবাজি’ জেলে যান লিমন

প্রকাশনার সময়: ২১ মার্চ ২০২৩, ০৯:০১

আরাভ খানের পরিবর্তে ৯ মাস জেল খাটেন চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার আইনপুর গ্রামের নুরুজ্জামানের ছেলে আবু ইউসুফ লিমন। পুলিশ কর্মকর্তা খুনের মামলায় ৫ দফা গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর মোটা অঙ্কের টাকা ও ক্রিকেটার বানানোর শর্তে জেল খাটতে রাজি হন লিমন।

যদিও পরে ঘটনা প্রকাশ পায়। বর্তমান জামিনে আছেন লিমন। কিস্তু এরই মাঝে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে পরিবারটি। এমন পরিস্থিতিতে তারাও আরাভের বিচার দাবি করছেন বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে।

এদিকে, আরাভের আসল আশ্রয়দাতা কে— তা এখনো ধোঁয়াশার মধ্যে থাকলেও তদন্তকারী সংস্থাগুলো কয়েকজনের নাম পেয়েছে। ওইসব নাম যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তবে বনানীতে এসবির পরিদর্শক মামুন ইমরান খান হত্যা মামলার অন্যতম আসামি আরাভকে রক্ষা করতে দীর্ঘদিন গুলশান ও বনানী এলাকায় দায়িত্বরত ইন্সপেক্টর সোহেল রানা সব ধরনের সহায়তা করেছেন। সোহেল রানা বর্তমানে বরখাস্ত হয়ে ভারতের একটি কারাগারে আটক আছেন। এছাড়া ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গেও আরাভের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাচ্ছে।

লিমনের মা হালিমা বেগম বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ২০১৬ সালে এসএসসি পাসের পর আবু লিমনকে কুমিল্লার ঠাকুরপাড়ার ম্যাটস-এ মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট কোর্সে ভর্তি করানো হয়। ৩ বছর পড়ার পর সে ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা না দিয়ে ক্রিকেট খেলতে ঢাকায় চলে যায়। এ নিয়ে বাবা ও আমাদের সঙ্গে তার মনোমালিন্য হয়।

এক সময় বাবা তার খরচ চালানো বন্ধ করে দেয়। ঢাকায় গিয়ে আবু ইউসুফ ক্রিকেট খেলার জন্য ভালো সুযোগ খুঁজতে থাকে। সেখানে আরাভের সঙ্গে ওর যোগাযোগ হয়। আরাভ বিকেএসপিতে খেলার সুযোগ করে দেবে বলে ইউসুফের আইডিকার্ড-সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন কাগজপত্র নেয়। পরে কাগজপত্র হাতে পেয়ে আরাভ ভয়ভীতি প্রদর্শন করে তার মামলায় ইউসুফকে জেলে যেতে বাধ্য করেন।

তিনি বলেন, আরাভের প্রলোভনে পড়ে লিমন জেলে গেলেও পরিবারের কাছে বিষয়টি গোপন রাখে। এর মধ্যে আরাভ একদিন ইউসুফের বাবাকে ফোন করে জানায়, সে ইউসুফকে বিকেএসপিতে ট্রেনিংয়ে পাঠিয়েছে। ইউসুফের খেলাধুলার পুরো দায়িত্ব তার (আরাভের)। লিমনকে দেড় মাসের মধ্যে জেল থেকে বের করার আশ্বাস দিয়েছিল আরাভ। ৩ মাসেও বের করতে না পারায় বাসায় ফোন করে সব ঘটনা খুলে বলে ইউসুফ। কান্নাকাটি করে। এরপর ৯ মাস জেল খাটার পর লিমন জামিন পান।

পুলিশ সদর দফতরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, আরাভ ঠান্ডা মাথার ক্রিমিনাল। স্বর্ণ চোরাচালান করেই কয়েকশ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এছাড়া আলোচিত মডেল পিয়াসা ও নজরুল রাজের সঙ্গেও আরাভের ভালো সম্পর্ক আছে। ব্যবসায়ী ও পুলিশে যাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে প্রয়োজনে তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আরাভকে দেশে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলকে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

এরপর ইন্টারপোল থেকে তার নামে রেড নোটিশ জারি করা হয়েছে। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে তাকে দেশে আনা সম্ভব হবে। জানা গেছে, বনানীর একটি ফ্ল্যাটে জন্মদিনের দাওয়াতে গিয়ে খুন হন এসবির কর্মকর্তা মামুন ইমরান খান। গুম করতে লাশ গাড়িতে করে নেওয়া হয় গাজীপুরের কালীগঞ্জের একটি জঙ্গলে। সেখানে লাশে পেট্রোল ঢেলে আগুনে ঝলসিয়ে দেওয়া হয় চেহারা। আরাভের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ১২টি ওয়ারেন্ট আছে বলে পুলিশ জানতে পেরেছে।

পুলিশ সদর দফতরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, আরাভ আপাদমস্তকের একজন প্রতারক। গরিব ও নিরীহ একটি ছেলেকে ‘খুনি’ বানাতে চেয়েছে। আরাভের অপকর্মে বেশি সহায়তা করেছেন ইন্সপেক্টর সোহেল রানা। আর সোহেল রানাকে আশ্রয়-প্রশয় দিতেন সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তাদের আস্করা পেয়ে সোহেল বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তারা সোহেল রানার মাধ্যমে আরাভের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তাদের পাশাপাশি কয়েকজন ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও মডেলরা সহায়তা করছেন আরাভকে।

জানা যায়, আরাভ রবিউল ইসলাম, আপন, সোহাগ, হূদয়, ও হূদি নামে পরিচিত। পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক মামুন এমরান খান হত্যা মামলায় তিনি পলাতক আসামি। মূলত, ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান দুবাইয়ে আরাভের স্বর্ণের দোকান উদ্বোধনের ঘোষণার পর আলোচনায় আসেন তিনি। তার বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায়। ২০১৮ সালে পুলিশ কর্মকর্তা মামুন হত্যা মামলায় আরাভ খানসহ আটজনের সংশ্লিষ্টতা পায় ডিবি।

এদের মধ্যে আরাভ পলাতক ছিলেন। তাকে গ্রেফতারে পাঁচ দফা গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। অবশেষে ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর আদালতে আত্মসমর্পণ করেন আরাভ। কিন্তু পরে জানা যায়, আরাভ খানের পরিবর্তে জেলে যান চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার আইনপুর গ্রামের নুরুজ্জামানের ছেলে আবু ইউসুফ লিমন। ফেসবুক সূত্রে আরাভের সঙ্গে পরিচয়। পরে কোনো এক সময় আরাভকে ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহের কথা জানান।

তখন আরাভ জানায়, দেশে এলে সব ব্যবস্থা করে দেবে। সাকিব আল হাসানের সঙ্গেও খেলার সুযোগ করে দেবে। কিন্তু মামলার কারণে সে দেশে আসতে পারছে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুবাইয়ের স্বর্ণ ব্যবসায়ী আরাভ খানই কোটালীপাড়ার আশুতিয়া গ্রামের রবিউল ইসলাম ওরফে হূদয় ওরফে সোহাগ মোল্লা। তার উত্থানের গল্প বিস্ময়কর। আরাভ তিন ভাইবোনের মধ্যে বড়।

তার বাবা জীবিকার তাগিদে যুবক বয়সে কোটালীপাড়ায় এসেছিলেন। সেখানে সিলভারের হাঁড়ি-পাতিল কাঁধে বহন করে ফেরি করতেন। সংসারের অভাব দেখে ঢাকায় চলে আসেন আরাভ। এরপর উচ্চবিত্ত শ্রেণির নারীদের টার্গেট করতে থাকেন তিনি। বিয়ে করেন একাধিক। পাঁচ-সাতজন নারী এলাকায় তার স্ত্রী দাবি করেছিলেন। এ নিয়ে নানা সময়ে সালিশও হয়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হরুন অর রশীদ বলেন, আরাভ সম্পর্কে আরও তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। আশা করি অল্প সময়ের মধ্যে তথ্য উদঘাটন করা হবে। তাছাড়া আরাভকে দেশে ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

এদিকে পুলিশের একটি সূত্রমতে, আরাভ খানের বিচরণ ছিল কক্সবাজারের ইয়াবা সাম্রাজ্যে। যাতায়াত ছিল কক্সবাজারের ইয়াবা অধ্যুষিত এলাকা টেকনাফে। কক্সবাজার শহরজুড়ে তার বেশ কিছু লোকজন ইয়াবা কারবারের ফরমায়েশ কাটত। কক্সবাজার শহরের কিছু যুবককে সঙ্গে নিয়ে ইয়াবা বাণিজ্যের সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন আরাভ খান। দুবাইয়ে স্বর্ণের দোকান খুলে তাক লাগিয়ে দেয়া আরাভ খানে কক্সবাজারে আনাগোনা সম্পর্কে মিলেছে নানা তথ্য।

সূত্রমতে, দীর্ঘদিন ধরে আন্ডারগ্রাউন্ড এক মাফিয়া কোটিপতির কেয়ারটেকার হিসেবেই কাজ করেছেন তিনি। সেই নেপথ্য গডফাদারেন স্বর্ণ ও ইয়াবা চোলাচালানের দেখভাল করার দায়িত্ব তাকে পৌঁছে দিয়ে সফলতার শীর্ষে। কক্সবাজার শহরের বাহারছড়া এলাকার সেফায়েত হোসেন জয় নামের এক তরুনের সঙ্গে আরাভ খানের সখ্য’র বিষয়ে জানা গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।

সূত্রমতে, জয় এবং জসিম নামের আরেক যুবকের সঙ্গে আরাভ খানের সখ্য’র পেছনের কারণ ছিল টেকনাফে ইয়াবা কারবারিদের আত্মমর্পণ। মাদকবিরোধী অভিযানের পর ক্রস ফায়ারের ভয়ে অনেকেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। আত্মসমর্পণের মাধ্যমে নিজেদের সুরক্ষিত রাখার কৌশল হিসেবে ইয়াবা বাণিজ্যের হোতাদের অনেকেই নিজেদের পুলিশ হেফাজতে নেন।

পুলিশ তৎকালীন এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে মধ্যস্থতান মাধ্যমে ইয়াবা বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত বেশ কিছু ব্যবসায়ীকে আত্নসমর্পণের সুযোগ করে দেয়ার ইস্যুতেই কোটি কোটি টাকার লেনদেনের মধ্যমণি ছিলেন রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খান। সোহাগ মোল্লা নামে তখন তিনি নিজের পরিচয় দিতেন।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ