২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের ভয়াল গ্রেনেড হামলার কথা মনে হলে সবচেয়ে বেশি চোখে ভাসে রক্তাক্ত আইভি রহমানের ছবি। ছবিটিতে আরেকজনকে দেখা যায়, যিনি আইভি রহমানকে নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় আছেন; আহাজারি করছেন। তিনি তৎকালীন ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সহসভাপতি বর্তমান মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা মো. আবুল কাশেম।
ভীতিকর দিনটিতে কী ঘটেছিল, সে অভিজ্ঞতা জানতে কথা হয় আবুল কাশেমের সঙ্গে। আবুল কাশেম বলেন, ‘সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে ওনাকে (শেখ হাসিনা) নূর হোসেন চত্বর থেকে রিসিভ করে আমরা ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে নিয়ে যাই। সময়টা ছিল তখন বিকাল সাড়ে ৩টা থেকে ৪টার কাছাকাছি। নেত্রীকে নিয়ে যাওয়ার পর আমি অবস্থান করি নেত্রীর গাড়ির প্লাগস্ট্যান্ডের কাছাকাছি। ওইদিন প্রচণ্ড গরম ছিল। এর মধ্যে মানুষের গাদাগাদি অবস্থান।সমাবেশের কিছুক্ষণ পর বিকট আওয়াজ পাই। বিকট আওয়াজের পর মানুষ চারদিকে দৌড়াতে শুরু করলেন। আমি ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের জয় মার্কেটের গেটে যাওয়ার পর মাটিতে পড়ে যাই। এর পর কত মানুষ যে আমার ওপর দিয়ে গেছে তার হিসাবে নেই।’
‘আমি ঘাড়টা তুলে দেখি নেত্রীকে ব্যারিকেড দিয়ে গাড়িতে ঢুকানো হচ্ছে। যারা নেত্রীকে ঢুকাচ্ছেন তারা আমাদের দলেরই নেতাকর্মী। তখন বুঝতে পারিনি নেত্রী বেঁচে আছেন, না মরে গেছেন, এই ভেবে আহাজারি শুরু করি। আহাজারি করার কারণ, নেত্রী বেঁচে না থাকলে আমার পরিবারের রক্ষার আর কেউ থাকবে না। পরিবারের সবাইকে বিএনপি-জামাতের লোকরা মেরে ফেলবে।’
‘সুরঞ্জিত দা, হানিফ ভাই রক্তাক্ত অবস্থায় বের হচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর দেখলাম সাহারা খাতুন বের হচ্ছেন। সাহারা খাতুনকে ধরে ওনার গাড়ির ড্রাইভারের কাছে পৌঁছে দিলাম। ওনার গাড়ি স্টেডিয়ামের কর্নারে অবস্থান করছিল। ওখানে পৌঁছতে প্রায় ১৫ থেকে ২০ মিনিট সময় লাগল।’
কাশেম বলেন, ‘এইরকম ভাবনা যখন ভাবতেছি তখন আমাদের ছাত্রলীগের নেতা এবং সাংবাদিক শাহেদ ভাইকে দেখি এবং জিজ্ঞেস করি, ‘শাহেদ ভাই নেত্রীর কী অবস্থা?’ তিনি বলেন, ‘নেত্রী আছেন।’
কাশেম বলেন, ‘নেত্রী চলে যাওয়ার পর পার্টি অফিসের দিকে পুনরায় আসি। তাকিয়ে দেখি রক্তাক্ত, ছিন্নভিন্ন দেহ পড়ে আছে। দেখি আইভি চাচি পড়ে আছেন। কাছে এসে দেখি তার দুটি পা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আমি বুকে কান রেখে বোঝার চেষ্টা করি তিনি বেঁচে আছেন কিনা। ‘‘সেখান থেকে আবার ব্যাক করলাম। এসে দেখি আইভি চাচি ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর ট্রাকের পাশের রাস্তায় শুয়ে আছেন। এর ভেতর লক্ষ করলাম, পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি করছে। অনেক আহত এবং ডেড বডিকে পুলিশ লাথি মারতে দেখলাম। ওনাকে (আইভি রহমান) তুললাম। আমি দেখলাম উনি বেঁচে আছেন কিনা। আশপাশে রিকশা নেই, গাড়ি নেই, ভ্যান নেই, কিছু নেই। তাকে তুলে দেব কোথায়? ধরেই রাখলাম! কিছুক্ষণ পর লিটন এলেন। লিটন আইভি চাচির পারিবারিক মেম্বার। দুজনে ধরে রাখলাম; কিন্তু দেব কার কাছে? নিমু কোথায়?। পরে পিছনে তাকিয়ে দেখলাম নেত্রীর গাড়ির ড্রাইভার আলী হোসেন (শহীদ নূর হোসেনের ভাই) একটা গাড়ি নিয়ে এলেন। তখন আমি আলী হোসেন ভাইকে বললাম, ভাই আইভি চাচি এখানে পড়ে আছেন, ওনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাও। তখন ধরাধরি করে আইভি চাচিকে গাড়িতে তুলে দিলাম।’
আবুল কাশেমের ভাষ্য, ‘আমার সঙ্গে লিটন, রবিউল হোসেন কচি ছিল। তখন উদ্ধারকর্মী কেউ ছিল না। আর সারা এলাকায় তো দেহ একটা জায়গয়, বুক এক জায়গয়, পা এক জায়গয়, হাত এক জায়গয়। বিচ্ছিন্ন-এলোপাতাড়ি, জুতা আর জুতা, সব মিলে এক ভয়ানক দৃশ্য।’
‘ওই স্মৃতি মনে পড়লে আমার এখনো ঘুম হয় না। আতঙ্কে ঘুম থেকে উঠে যাই। উঠে ঝিম ধরে বসে থাকি। এক দিকে হাত, এক দিকে পা। আমাদের সঙ্গে ছাত্ররাজনীতি করেছেন সেন্টু ভাই। তার কী বীভৎস মৃত্যু; কী ভয়ঙ্কর মৃত্যু। এগুলো মনে হলে মাথা ঠিক থাকে না। অনেক সময় ঘুম থেকে উঠে ঝিম ধরে খাটের এক কোনায় বসে থাকি’ বলেন কাশেম।
তার ভাষ্য, ‘আমার রাজনীতি খুব একটা সামনের দিকে এগিয়ে যায়নি। ছাত্রলীগের পর যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হয়েছিলাম। সেখানে রাজনীতি বেশি দিন করিনি। তার পর নেত্রী আমাকে মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য করেছিলেন। সামনে নেত্রী কমিটি করবেন, তিনি কর্মী হিসেবে রাখলে রাখবেন।’
এখন কেমন আছেন জানতে চাইলে আবুল কাশেম বলেন, ‘নেত্রীর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও শ্রদ্ধা রেখে ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে আছি, এটাই আমার আনন্দ।’
নয়া শতাব্দী/এম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ