রাজশাহীর পদ্মা নদীতে পানি বৃদ্ধিতে স্বপ্ন ভাঙছে তীরবর্তী মানুষের। শতাধিক মানুষের ঘরবাড়ি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে এবং ২০০০ লোক পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
জানা গেছে, কয়েক মাস পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। ফলে ছিন্নমূল ও নিম্ন আয়ের মানুষের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে।
এছাড়া রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে পদ্মার পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তীব্র স্রোতে লঞ্চঘাটে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ঈশ্বরদীর পদ্মা নদীতে অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধির ফলে উপজেলার চরধাপাড়ী মৌজার মোল্লাপাড়ায় বিপুলসংখ্যক মানুষ পানিবন্দি ও নাটোরের লালপুর উপজেলায় পদ্মা নদী, সিংড়ার আত্রাই নদী ও বড়াইগ্রাম গুরুদাসপুরের নদ্দকুজা ও নলডাঙ্গার বারনই নদীতে হঠাৎ পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় কয়েকশ’ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
রাজশাহী : পদ্মা নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে নদীতীরবর্তী ছিন্নমূল ও নিম্ন আয়ের মানুষের খড়ের ছাউনি ও টিনের বেড়া দিয়ে গড়ে তোলা বাড়িঘরে পানি ঢুকছে। বাঁচার তাগিদে তারা ঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছেন। প্রতিবছর বর্ষা এলেই জীবন ও জীবিকার জন্য তাদের দুশ্চিন্তা বাড়ে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এবারের বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকে পদ্মা নদীর পানি বাড়ছে। কিন্তু পানি বৃদ্ধির তীব্রতা কম ছিল। কিন্তু গত কয়েক দিনের বর্ষণে হঠাৎ করেই নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। কয়েক মাস পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে বলে জানা গেছে। ফলে ছিন্নমূল ও নিম্ন আয়ের মানুষের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে।
রাজশাহীতে চলতি মাসের শুরু থেকেই পদ্মা নদীর পানি বাড়ছে। ফলে শহরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে শহরের নিম্নাঞ্চলের নিম্ন আয়ের ও ছিন্নমূল প্রায় দুই হাজার পরিবার জলমগ্ন হয়ে পড়েছে।পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, বুধবার সকালে রাজশাহীর পদ্মা নদীতে পানি বিপদসীমার ৭৯ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, উজান থেকে বেয়ে আসা ঢলের কারণে পদ্মায় পানি বাড়ছে। সবেমাত্র নদীতে পানি বৃদ্ধি শুরু হয়েছে। নদীতে আরো পানি বাড়ার আশঙ্কা করছেন তারা।
পাউবো জানায়, ‘৮৮ রামপুর-বোয়ালিয়া, রাজশাহী’ স্টেশনে গত মঙ্গলবার সকাল ৬টায় পদ্মার পানির উচ্চতা ছিল ১৭ দশমিক ৫৯ মিটার। বেলা ৩টায় এই পানি ৪ সেন্টিমিটার বেড়ে ১৭ দশমিক ৬৩ সেন্টিমিটার উচ্চতায় ওঠে। আর বুধবার সকাল ৬টায় সেখানে পানি বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ দশমিক ৭১ সেন্টিমিটারে।
রাজশাহী পাউবোর হাইড্রোলজি বিভাগের পানি পরিমাপক এনামুল হক জানান, বৃষ্টির কারণে উজান থেকে বেয়ে আসা ঢলের কারণে পদ্মায় পানি বাড়ছে। আগস্ট মাসজুড়েই পানি এভাবে বাড়তে পারে বলে ধারণা করেন তিনি।
এদিকে, পদ্মা নদীতে পানি বৃদ্ধির কারণে নদীতীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের বাসিন্দাদের বাড়িতে পানি ঢুকে গেছে।
ভারতের সীমান্তঘেঁষা রাজশাহীর বাঘায় ৭নং চকরাজাপুর ইউনিয়নসহ অন্যান্য ইউনিয়নে আংশিক পদ্মার পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
চকরাজাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুল আযম বলেন, কয়েক দিন ধরে আমার ইউনিয়নের লোকজন বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। তার মধ্যে লক্ষ্মীনগর চর, পলাশীচর, চৌমাদিয়া ও কালিদাসখালী চর বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লোকজন বাড়িঘর ভেঙে উঁচু এলাকার খোলা আকাশের নিচে দিনাতিপাত করছে। জনদুর্ভোগ, গবাদি পশু, মহিষ, ছাগল নিয়ে মানবেতর জীবনযাবন করছে জনগণ।
বাঘা উপজেলা চেয়ারম্যান বলেন, নির্বাহী অফিসারকে ইউনিয়নের নদী ভাঙন ও বন্যায় বাড়িঘর ফসলের ক্ষতি সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে। শতাধিক মানুষের ঘরবাড়ি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে এবং দুই হাজার লোক পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
রাজবাড়ী : পদ্মার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় গোয়ালন্দের দৌলতদিয়া লঞ্চঘাটের পল্টুন ভেঙে দেবে গেছে। ফলে বুধবার দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে লঞ্চ পারাপারে ঝুঁকিতে পড়েছে যাত্রীরা।
এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, লঞ্চঘাটের কাছে স্রোতের ঘূর্ণিতে পল্টুনে ওঠার পাটাতনের সামনের অংশ নদীতে চলে গেছে। ইতোমধ্যে একবার লঞ্চঘাট সরিয়ে নেয়া হলেও আবার ভাঙনের কারণে পল্টুন সরাতে বাধ্য হচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
লঞ্চঘাটের ৩০ মিটারের মতো ভাঙনের কারণে শুধু লঞ্চঘাটই নয় , স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের বাড়িঘর সরিয়ে নিচ্ছে। বর্তমানে মারাত্মক ভাঙনের কারণে যে কোনো সময় এটি বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
দৌলতদিয়া ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বর আশরাফুল ইসলাম বলেন, বুধবার ভোর থেকে লঞ্চঘাট এলাকায় বেশকিছু জিও ব্যাগ ডাম্পিং করা হয়েছে। সেগুলো নদীর গভীরে চলে যাচ্ছে। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে পুরো এলাকা নদীতে চলে যাবে।
বুধবার রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের দৌলতদিয়া পয়েন্টে পদ্মায় ২৪ ঘণ্টায় পানি বেড়েছে ১৫ সেন্টিমিটার। যা বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। স্ট্যান্ডার্ড লেভেল ৮.৬৫ সেন্টিমিটার। বর্তমানে প্রবাহিত হচ্ছে ৮.৮০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে। যা বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এদিকে পর্যাপ্তসংখ্যক ফেরি থাকলেও নদীতে অত্যধিক স্রোতের কারণে দৌলতদিয়া ফেরিঘাট ও রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ মোড় এলাকায় সহস্রাধিক ট্রাক-লরি অপেক্ষমাণ।
রাজবাড়ী সদর উপজেলার গোয়ালন্দ মোড়ে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় ট্রাকের দীর্ঘ সারি দেখা দিয়েছে। রাত থেকে ফেরিতে পারাপারের জন্য যানবাহনগুলোকে রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া আঞ্চলিক মহাসড়কে অপেক্ষমাণ রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিসি) দৌলতদিয়ার সহকারী ব্যবস্থাপক খোরশেদ আলম বলেন, ঘাটে ১৬টি ফেরিই চলাচল করছে।
তবে স্রোতের কারণে পারাপার হতে বেশি সময় লাগছে। এছাড়া ৪ নম্বর ঘাটে ফেরি ভিড়তে পারছে না। মাওয়াঘাটের ফেরি এই নৌপথ দিয়ে যাচ্ছে। এতে করে সাধারণ সময়ের চাপ বেড়েছে। সবমিলিয়ে পারাপারের জন্য অপেক্ষমাণ গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে।
ঈশ্বরদী : পদ্মা নদীতে অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধির ফলে ঈশ্বরদী উপজেলার চরধাপাড়ী মৌজার মোল্লা পাড়ায় বিপুলসংখ্যক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এতে বিশুদ্ধ পানি ও চুলা জ্বালিয়ে রান্না করতে না পারায় তাদের দুর্ভোগ বাড়ছে বহুগুণ। চর পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় গো-খাদ্যের চরম সংকট দেখা দেয়।
গো-খাদ্যের অভাবে গবাদি পশু নিয়েও ভোগান্তিতে পড়তে হয় বন্যাকবলিত চরের মানুষদের। এ অবস্থায় চরের বাসিন্দারা গরু-মহিষসহ গবাদি পশু এবং ঘরবাড়ি ভেঙে নিয়ে নৌকায় করে এপারে আসছেন।
এদিকে বুধবার সরেজমিনে দেখা গেছে, নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় ঈশ্বরদী উপজেলার সাঁড়া ইউনিয়নের আড়মবাড়িয়া, গোপালপুর গ্রামের কয়েকটি স্থানে ব্লকের বাঁধের ওপর দিয়ে পানি উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। গোপালপুর গ্রামের সাইদুলের মল্লিকের বাড়ি ও দোকানে, আরজু, ইসরাইলের বাড়ির আঙিনায় প্রবেশ করেছে।
কৃষি বিভাগ বলছে, নদীর চরে কৃষকের আখ ক্ষেতে নদীর পানি প্রবেশ করেছে। এতে তেমন ক্ষতির সম্ভাবনা নেই।
নাটোর : লালপুর উপজেলায় পদ্মা নদী, সিংড়ার আত্রাই নদী ও বড়াইগ্রাম গুরুদাসপুরের নদ্দকুজা ও নলডাঙ্গার বারনই নদীতে হঠাৎ পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় কয়েকশ’ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি ফসলি জমি ও বিভিন্ন বাগানসহ অনেক নিচু এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়ছে। লালপুরের নদীপারের প্রায় ৮০০ একর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। সিংড়া উপজেলার ইটালী ইউনিয়নের রাতাল গ্রামে পানি বের হতে না পারায় ১৫ হেক্টর জমির ফসল ডুবে গেছে বলে জানিয়েছেন সিংড়া উপজেলা কৃষি অফিসার সেলিম রেজা। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, জেলায় এখনো পানি বিপদসীমার নিচে রয়েছে।
জানা যায়, কয়েক দিন যাবৎ পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বিলমাড়ীয়া ইউনিয়নের নওশারা সুলতানপুর, চাকলা বিনোদপুর, দিয়াড়শংকরপুর, আরাজি বাকনাই, রসুলপুর ও মোহরকয়ার আংশিক এলাকা পানিতে ডুবে গেছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে চরের গ্রামগুলোর প্রায় ৫০০ পরিবার। এখানকার প্রায় ৮০০ একর জমির সবজিসহ উঠতি ফসল ডুবে গেছে। মোহরকয়া গ্রামের আনোয়ার পারভেজ জানান, তার চার বিঘা জমিতে পটোল, ঢেঁড়স, মুলা ও কুমড়ার আবাদ তলিয়ে গেছে।
নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু রায়হান বুধবার বিকালে বলেন, লালপুরের পদ্মা নদীর পানি এখনো বিপদসীমার এক মিটার নিচ দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার বাকি সব নদীর পানি অন্য বছরের তুলনায় এবার এখনো কম আছে। তবে তিস্তার পানি চলে এলে বিপজ্জনক হতে পারে।
নয়া শতাব্দী/এম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ