বিধিনিষেধ শিথিলে চার দিনের ব্যবধানে পাল্টে গেছে রাজধানীসহ সারাদেশের চিত্র। করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে মানুষের চলাচলে বোঝার উপায় নেই এখনো কঠিন সময় পার করছে দেশ। বিধিনিষেধ প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ ভুলে গেছেন স্বাস্থ্যবিধিও। নাক, মুখ ঢেকে মাস্ক পরার যে নিয়ম তাও মানা হচ্ছে না। পকেটে মাস্ক রেখে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন অনেকে।
বেশি জনসমাগম করতে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা কেউই মানছেন না। ফলে সবকিছু খুলে দেয়ায় আবারো করোনা সংক্রমণ বাড়ার শঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, দুই থেকে তিন সপ্তাহ পর প্রভাব পড়বে আক্রান্তের সংখ্যায়। গত কয়েকদিন মৃত্যু ও সংক্রমণ কম থাকা মানে আরেকটা বড় ঝড় আসার ইঙ্গিত।
সংক্রমণের মাত্রা স্থির থাকাটাই হল বড় ঝড়ের আগের লক্ষণ। সেপ্টেম্বর শেষে বা অক্টোবরের শুরুতেই করোনার তৃতীয় ঢেউ আসতে পারে।
আগের দুই দফা সামাল দেয়া সম্ভব হলেও তখন আরো বেশি কঠিন হবে। স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতের পাশাপাশি সুশৃঙ্খলভাবে টিকা কার্যক্রম পরিচালনা করা না গেলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতে পারে।
নয়া শতাব্দীর সঙ্গে একান্ত আলাপকালে এমন আশঙ্কাই প্রকাশ করেছেন দেশের প্রথিতযশা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। অবশ্য আশার কথা শুনিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিক নিয়ম মেনে মাস্ক পরলে করোনা সংক্রমণ ছড়ানো সম্ভাবনা কমে যায়। শুধু মাস্ক পরেই সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব অনেকাংশে। জীবন-জীবিকার তাগিদে দীর্ঘদিন লকডাউন দেয়া সম্ভব নয়। লকডাউনও কোনো সমাধান নয়।
তাই মানুষকে স্বাভাবিক জীবনে আসতেই হবে। বেশি দিন বাঁচতে হলে অন্তত মাস্ক পরার অভ্যাসটি ঠিক রাখতে হবে। তাহলে করোনা প্রতিরোধ করা সম্ভব। লকডাউন শিথিল সময়ে মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে সামনের দিনগুলোতে মহাবিপদ অপেক্ষা করছে।
এদিকে, স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, সবকিছু খোলা রেখে করোনার মতো মহামারি ঠেকানো কঠিন। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনে আবারো সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার পরামর্শ দেবে স্বাস্থ্য অধিদফতর। তবু জীবিকার তাগিদে বর্তমানে লকডাউন তুলে নেয়া হয়েছে।
মানুষের অবাধ চলাচলের প্রভাব পড়বে করোনা সংক্রমণে। আর দুই সপ্তাহের মধ্যেই তা অনেকটাই দৃশ্যমান হবে বলে শঙ্কা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের। এ বিষয়ে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. ফজলে রাব্বী নয়া শতাব্দীকে বলেন, সংক্রমণের হার ১০ শতাংশের নিচে এলে আংশিকভাবে খোলা যায়। আর তা যদি টানা দুই থেকে চার সপ্তাহ ৫ শতাংশের নিচে থাকে তবে বলা যায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এসেছে। আরো চার থেকে ছয় সপ্তাহ লকডাউন থাকলে হয়তো সংক্রমণের হার নিচে নেমে আসত।আগামী এক দুই সপ্তাহ সংক্রমণের হার কমার দিকে থাকলেও সব খুলে দেয়ায় সামনে আবার তা বাড়তে পারে। লকডাউন স্থায়ী সমাধান নয় তবে সাময়িক নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ব্যবস্থা দরকার।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা বলেন, এ অবস্থায় করোনা নিয়ন্ত্রণ কঠিন। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। আমাদের জীবন-জীবিকার স্বার্থে লকডাউন তুলে দেয়া হয়েছে। তবে বিজ্ঞান বলছে যে এভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। আমরা এখন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। লকডাউন তুলে নেয়া হলেও স্বাস্থ্যবিধি মানায় জোর দেয়া হবে।
জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. আবু জামিল ফয়সাল নয়া শতাব্দীকে বলেন, করোনা নিয়ন্ত্রণে আমাদের পলিসির কিছু কিছু ভুল থাকতে পারে। তারপরও সবার আগে দেশের মানুষ ও জীবন-জীবিকার কথা চিন্তা করে সবকিছু খুলে দেয়া হয়েছে। এখানে বড় আকারে নির্দেশনা দেয়া দরকার ছিল- স্বাস্থ্যবিধি না মানলে আবার লকডাউন দেয়া হবে। বন্ধ থাকবে সবকিছু। তাহলে জীবিকার তাগিদে অনেকেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলত।
তিনি বলেন, লকডাউনে খাবারের প্রণোদনার প্যাকেজের মাত্র ৬ শতাংশ ব্যয় হয়েছে। যদি অসহায় মানুষদের ঘরে ঠিকমতো খাবার পৌঁছানো যেত তাহলে আরো বেশি মানুষকে ঘরে রাখা সম্ভব হতো। প্রণোদনা প্যাকেজের সঠিক ব্যবহার করতে পারলে লকডাউন আরো বেশি কার্যকর হতো।
তিনি আরো বলেন, করোনা শুরুর ভয় এখন আর নেই। সবাই উদাসীনভাবে চলাচল করছে। এভাবে চলাচলে সংক্রমণ আরো বাড়ার সম্ভাবনা করেছেন খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী। আর ভীষণভাবে বাড়ার আশঙ্কা করছে টেকনিক্যাল কমিটি। আমরা ভুলে যাচ্ছি- সংক্রমণ এখনো নিজের গতিতে চলছে। সংক্রমণের গতি ২০ শতাংশের বেশি। এখনো ৫ শতাংশে আসেনি। খুলনা-চট্টগ্রামসহ বেশ কয়েকটি জেলায় সংক্রমণের হার ৩০-৪০ শতাংশের কাছাকাছি। আবার দুই চার দিন জ¦রে ভুগে মারা যাচ্ছেন অনেক বেশি মানুষ। বেশি বেশি টেস্ট করাতে পারলে আরো ভালো হতো।
আবু জামিল ফয়সাল আরো বলেন, মৃত্যু ও সংক্রমণ দুই-চার দিন কমতে থাকা মানে আরেকটা ঝড়ের পূর্বাভাস। সংক্রমণের গতি চুপ থাকা হলো বড় ঝড়ের আগের লক্ষণ। সংক্রমণের ঝড় আসবেই। তাই সবাইকে মাস্ক পরতে হবে। বিশৃঙ্খলা ও ভিড় এড়িয়ে সবাইকে সুপরিকল্পিতভাবে টিকা দিতে হবে। এক্ষেত্রে সামাজিক সংগঠন ও জনগণকে কাজে লাগাতে হবে। সবাইকে বোঝাতে হবে, এটি একটি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। বেশি বছর বাঁচতে হলে মাস্ক পরতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
একই বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ডা. লেলিন চৌধুরী নয়া শতাব্দীকে বলেন, দুইটা বিষয় রয়েছে এখানে। প্রথমত- দেশে এখনো সংক্রমণের মাত্রা ২০ শতাংশের বেশি। বিজ্ঞানের ভাষায় এটা সবোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে অতি দ্রুতই দুই বা তিন সপ্তাহের লকডাউন দেয়ার প্রয়োজন। তবে বাংলাদেশের জীবন-জীবিকার বাস্তবতায় লকডাউন আর দেয়া সম্ভব হয়নি। এক্ষেত্রে যেসব এলাকায় বেশি সংক্রমণের ঝুঁকিতে আছে সেইসব এলাকায় বিধিনিষেধ দেয়ার দরকার ছিল। আর কম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা সবকিছু চালু করা যেত। দ্বিতীয়ত, মাস্ক ও টিকা। সবাইকে সঠিকভাবে মাস্ক পরাকে অভ্যাসে নিতেই হবে। করোনা প্রতিরোধে এটি সবচেয়ে বড় পন্থা। কিন্তু মানুষকে মাস্ক পরার ব্যাপারে সচেতন করার যে কাজটি করার দরকার ছিল, সরকার সেটি করেনি। যত দ্রুত সম্ভব দেশের ৮০ শতাংশ জনগণকে টিকা আওতায় নিয়ে আসতে হবে। তাহলেই কেবল সংক্রমণের লাগাম আসবে।
তিনি আরো বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলার প্রভাব পড়বে আগামী সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরে মাসে। তখন সংক্রমণ বাড়ার পাশাপাশি মৃত্যু বাড়তে পারে। তাই স্বাস্থ্যবিধি না মানলেই বড় বিপদ আসবে। ফলে, সেপ্টেম্বর বা অক্টোবর শুরুতেই আবারো লকডাউন দিতে হতে পারে।
জানতে চাইলে বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ নয়া শতাব্দীকে বলেন, আমরা এখনো সংক্রমণের ঝুঁকিমুক্ত নই। সংক্রমণের মাত্রা এখনো ৫-৭ শতাংশের নিচে আসেনি। লকডাউন শিথিলের সময়ে সবাই ড্যাম কেয়ারভাবে চলাচল করছে। তাই স্বাস্থ্যবিধির ওপর বেশি জোর দিতে হবে। বিশেষত মাস্ক পরা ও হাত ধোয়ার কাজটি সবসময় করতেই হবে। মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করতে হবে। বাইরে যারা মাস্কবিহীন চলাফেরা করবে তাদের ব্যাপারে প্রশাসনকে আরো জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। মাস্ক না পরলে জেল-জরিমানার ব্যবস্থা করতে হবে।
তিনি বলেন, এখন জরুরি স্বাস্থ্যবিধি মানা, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক পরা এবং সবাইকে টিকার আওতায় আনা। স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করলেই সামনের দিনগুলোতে মহাবিপদ অপেক্ষা করছে। আগামী অক্টোবর মাসের শুরুতেই আরেকটি ঢেউ দেখতে হতে পারে। সেটা হবে দেশের তৃতীয় ঢেউ। তাই সর্বস্তরের জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে। সবাই মিলে জনগণকে সচেতন করে তুলে তৃতীয় ঢেউ আমরা ঠেকাতে পারব, সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে পারব। কারণ, সংক্রমণ বাড়লে মৃত্যুর ঝুঁকিও বাড়ে।
ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ আরো বলেন, লকডাউন দিলে সংক্রমণের মাত্রা কমবে। কিন্তু করোনা নিয়ন্ত্রণে এটা কোন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হতে পারে না। আগের ১৯ দিনের লকডাউনে নিন্ম দরিদ্র মানুষেরা অনাহারে দিন যাপন করেছে। চাকরি হারিয়ে অনেক বেকার হয়েছে। ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ ছিল। লকউাউনে শুধু সরকারি চাকরিজীবীরা মাসিক বেতন পেয়েছেন। অন্যরা বেতন পাননি। ফলে দিনের পর দিন লকডাউন কোনো সমাধান নয়। তিনি বলেন, টিকা দেয়ার ওপর বেশি জোর দেয়া দরকার। অতিদ্রুত অন্তত ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে পারলে এই ভয়াবহ মহামারি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হবে। তাহলেই সংক্রমণের লাগাম অনেকাংশে টেনে ধরতে পারব আমরা।
নয়া শতাব্দী/এসএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ