ঢাকা, বুধবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ১৪ কার্তিক ১৪৩১, ২৬ রবিউস সানি ১৪৪৬

করোনায় বাড়ছে শিশুশ্রমিক

প্রকাশনার সময়: ১৭ আগস্ট ২০২১, ০১:১৮ | আপডেট: ১৭ আগস্ট ২০২১, ০১:২৩

করোনাকালে চাকরি হারিয়ে অনেকে বেকার। আবার কাজ বন্ধ অনেকের। আর্থিক সংকটে পড়েছে দরিদ্র ও হতদরিদ্র মানুষেরা। করোনায় আয় কমার পাশাপাশি বেড়েছে দরিদ্রের সংখ্যাও। এমন পরিস্থিতিতে পরিবারের পাশে দাঁড়াতে কোমলমতি শিশুরা স্কুল বন্ধ থাকায় যোগ দিয়েছে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে। মূলত করোনাকালে অভিভাবকের কাজ এবং আয়ের ওপর প্রভাব পড়ায় প্রতিনিয়ত বাড়ছে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা। যদিও করোনার দেড় বছরে বিষয়টি নিয়ে হয়নি কোনো জরিপ বা গবেষণা। ফলে দেশের শিশুশ্রমিকের সংখ্যা জানে না সরকার। বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানেরও নেই গবেষণা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সম্প্রতি হাসেম ফুড কারখানায় নিহত শ্রমিকদের বড় একটি অংশই ছিল শিশুশ্রমিক। ২০২৫ সাল নাগাদ শিশুশ্রম নিরসনের যে পরিকল্পনা দুই দশক ধরে চলছে তা বাস্তবায়নে করোনা দিয়েছে নতুন ধাক্কা। তাদের মতে, বর্তমানে করোনা মহামারিতে অর্থনৈতিক ও শ্রমবাজারে ধাক্কা বিরাট প্রভাব ফেলছে মানুষের জীবিকার ওপর। দুর্ভাগ্যবশত এই সংকট নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো শিশুদের শিশুশ্রমের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। দারিদ্র্যের কারণে শিশুরা বাধ্য হচ্ছে কাজে নামতে। এছাড়া স্কুল বন্ধ থাকায় অনেকে সন্তানদের কাজে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ অনেক পরিবারের মোবাইল ডাটা কিনে সন্তানকে অনলাইনে ক্লাস করানোর সক্ষমতা নেই।

জানা গেছে, করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছে শিশু শিক্ষার্থীরা। ভাইরাসের প্রভাবে হতদরিদ্র পরিবারগুলোর উপার্জন কমে যাওয়ায় তাদের ছোট ছোট সন্তানদের কাজে লাগিয়ে দিচ্ছে। বিভিন্ন হাট-বাজার ও রাস্তাঘাটে চলাফেরার সময় চোখে পড়ছে বিদ্যালয়গামী শিশু-শিক্ষার্থীরা অনেক ভারি ভারি কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। আবার এক শ্রেণির ব্যবসায়ী কম পারিশ্রমিক দিয়ে চায়ের দোকান, হোটেল, ওয়ার্কশপ, মুদি দোকান ও ফার্নিচারসহ বিভিন্ন ভারি কাজে ওই শিশু-শিক্ষার্থীদের নিয়োজিত করছেন।

করোনার প্রকোপে কর্মহীন বাবা ও সংসারের হাল ধরতে বাধ্য হয়ে শিশুশ্রমিকের খাতায় নাম লিখিয়েছে অষ্টম শ্রেণির রবিউল। স্কুলব্যাগে করে মাস্ক বিক্রি করে। বাসে বসে এই প্রতিবেদককে বলেন, করোনার শুরুতে বাবার কাজ চলে যায়। আমার স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। পরিবারের কথা ভেবে লকডাউনের প্রথম দিকে ফুটপাতে করোনার সুরক্ষা সামগ্রী বিক্রি করি। ফুটপাতের দোকানপাট খোলার কারণে এখন আর বসতে পারি না। তাই বাসে বাসে বিক্রি করি। প্রতিদিনের ব্যস্ততাই তার নিত্যদিনের সংগ্রাম। জীবনযুদ্ধের অন্ধকার চোরাগলিতে এই পথচলা রবিউল ইচ্ছে করে বেছে নেয়নি।

যাত্রাবাড়ীর একটি গাড়ির গ্যারেজে কাজ করে ১২ বছরের সুজন মিয়া। গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর। এক বছর ধরে সে ওই গ্যারেজে কাজ করছে। সুজন বলে, স্কুলে পড়াশোনা করতাম, আব্বায় কাজ শিখানোর জন্য এখানে দিয়া গেছে। গ্যারেজের অন্য এক কর্মচারী বলেন, সুজনের বয়স হয় নাই। দোকানে দিতে বলেছিলাম। কিন্তু দেশগ্রামে অভাব বেড়েছে, মালিক রেখেছে শুধু মানবিকতার খাতিরে।

দুরন্ত শৈশবকে পেছনে ফেলে রবিউল-সুজনের মতো অনেক শিশু পেটের দায়ে শ্রমিকের খাতায় নাম লিখিয়েছে তার কোনো সাম্প্রতিক তথ্য নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ যে পরিসংখ্যান তাও ৮ বছরের পুরনো। ২০১৩ সালের জরিপে দেখা যায়, সে সময় দেশে প্রায় ৩৫ লাখ শিশু বিভিন্ন পেশায় কাজ করত। এটাই সরকারের সর্বশেষ জরিপ। তবে বিশ্লেষকদের মতে, করোনায় সেই সংখ্যাটা যে বহুগুণে বেড়েছে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই।

জানা গেছে, দেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসনে বিভিন্ন ধাপে প্রকল্প চলছে প্রায় দুই দশক ধরে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের অংশ হিসেবে ২০২৫ সাল নাগাদ দেশ থেকে সম্পূর্নরূপে শিশুশ্রম নিরসনের পরিকল্পনা সরকারের। ২০১৮ সালে যার চতুর্থ পর্যায় বাস্তবায়নে প্রায় ২৮৫ কোটি টাকা খরচ করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এক দফা সময় বাড়িয়ে প্রকল্পটি শেষ হবার কথা এ বছর। তবে সম্প্রতি হাসেম কারখানায় নিহত শ্রমিকদের বড় একটি অংশই শিশু হওয়ায় প্রকল্পের কার্যকারিতা নিয়েই উঠেছে নানা প্রশ্ন।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও ইউনিসেফের ২০২০ প্রতিবেদনে জানানো হয়, বিশ্বব্যাপী শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ১৬ কোটি। যা গত চার বছরে বেড়েছে ৮৪ লাখ। যা গত ২০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বৃদ্ধি। করোনার প্রভাবে আরো ৯০ লাখ শিশু ঝুঁকিতে রয়েছে। আগামী দুই বছরে আরো ৫ কোটি শিশুশ্রমিক বাড়তে পারে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বিষয়ে বলা হয়, মহামারির মধ্যে গত মার্চ ২০২০ থেকে স্কুল বন্ধ থাকা এবং দারিদ্র্য বৃদ্ধি অনেক শিশুকে শিশুশ্রমের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যা নিয়ে ইউনিসেফ উদ্বিগ্ন।

গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাভাইরাসের কারণে শহরের নিম্ন আয়ের মানুষের আয় কমেছে ৮২ শতাংশ। আর গ্রামাঞ্চলের নিম্ন আয়ের মানুষের আয় ৭৯ শতাংশ কমেছে। স্কুল বন্ধ ও পরিবারের আয় কমে যাওয়ায় অনেক শিশুর জন্য শ্রমে যুক্ত হওয়া ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। শিশুরা যত বেশি সময় স্কুলের বাইরে থাকে তাদের আবার স্কুলে ফেরার সম্ভাবনা ততটাই কম। তাদের স্কুলে ফেরা অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। ফলে, শিক্ষার্থীরা শিশু শ্রমে নিযুক্ত হওয়ায় বিদ্যালয় খুলে দেয়ার পরও উপস্থিতি কমবে।

জানতে চাইলে সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশের পরিচালক রিফাত বিন সাত্তার নয়া শতাব্দীকে বলেন, সবচেয়ে অসহায় শিশুদের জীবন, আশা-আকাক্সক্ষা ও ভবিষ্যতের ওপর করোনা বিশেষ নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এই করোনা পরিস্থিতিতে দরিদ্র আরো দরিদ্র হয়েছে। হতদরিদ্র একটি শ্রেণি তৈরি হয়েছে। এখন পরিবারে সচ্ছলতা না থাকলে শিশুকে কীভাবে স্কুলে পাঠাবে? ফলে তারা শিশুকেও কোনো না কোনো কাজে লাগিয়ে দিচ্ছে। এই কাজটা কিন্তু সাধারণ কোনো কাজ নয়, ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। আমাদের এখন শিশুদের শিক্ষা ও সুরক্ষার ওপর অগ্রাধিকার দেয়া উচিত।

কী পরিমাণ শিশু এখন স্কুলের বাইরে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে আনুষ্ঠানিক খাতে তো শিশুশ্রম বন্ধ। তারা কাজ করে অনানুষ্ঠানিক খাতে। সেখানে খুব একটা হিসাব সরকার রাখে না। ফলে আমরাও খুব একটা হিসাব জানতে পারি না। হিসাব না থাকায় এখান থেকে বের করে আনাও কঠিন। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক আবদুছ শহিদ মাহমুদ নয়া শতাব্দীকে বলেন, করোনার কারণে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। যে কারণে একবার যে শিশুটি স্কুল ছেড়ে পূর্ণকালীন কাজে যোগ দিচ্ছে, সেই শিশুটি আর স্কুলে ফিরবে না। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণেও শিশুশ্রম বাড়ছে। স্কুল খোলার আগ পর্যন্ত এই সংখ্যা আরো বাড়বে এতে সন্দেহ নেই।

নয়া শতাব্দী/এসএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ