এবারের বাজেটে পাচারের টাকা বৈধ করে দেশে ফেরানোর সুযোগ দেয়া হয়। আশা ছিল পাচার হওয়া টাকা দেশে বিনিয়োগ হবে, বাড়বে কর্মসংস্থান। কিছুটা হলেও চাঙা হবে দেশের অর্থনীতি। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। পাচার হওয়া টাকা দেশে ফেরানোয় কোনো সাড়া নেই। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য দেয়নি। তবে বোর্ডের একাধিক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন, প্রায় ছয় মাসেও সাড়া দেয়নি কেউ।
অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, অবৈধ পন্থায় দেশ থেকে টাকা বের হয়ে গেলে তা ফেরত আনা কঠিন। কারণ, যারা টাকা পাচার করেছেন, তারা ওই টাকা দিয়ে বিদেশে বাড়ি-গাড়ি কিনেছেন। সেই টাকা দেশে আনার পর যদি কোনো ঝামেলা হয়—এমন ভীতিও আছে।
সরকার কালোটাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল করলেও নির্ধারিত হারে কর দিয়ে দেশ থেকে পাচার করা টাকা বৈধ করার সুযোগ দিয়েছে এবারের বাজেটে। চলতি বাজেটে বলা হয়, বিদেশে থাকা যেকোনো সম্পদের ওপর কর পরিশোধ করা হলে এনবিআরসহ অন্য কোনো সংস্থা এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন তুলবে না। ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে যে টাকা দেশ থেকে চলে যায় সেটাই পাচার করা টাকা। কর ফাঁকি, ওভার ইনভয়েসিং, হুন্ডিসহ নানা কৌশলে এই টাকা পাঠানো হয়। চলতি অর্থবছরের বাজেটে বলা হয়েছে, স্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ, অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ এবং নগদ টাকা আনতে চাইলে ৭ শতাংশ কর দিয়ে পাচার করা টাকা বৈধ করা যাবে। চলতি বছরের জুলাই থেকে আগামী ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এ সুযোগ দেয়া হবে।
যারা টাকা ফেরত আনবে, তাদের শতভাগ গোপনীয়তা রক্ষা করা হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়। এনবিআর বলছে, সাড়া না মিললেও এই সুযোগ আরও এক বছর বাড়তে পারে।
তবে এনবিআরের সাবেক সদস্য আলমগীর হোসেন এই সুযোগ দেয়ার পক্ষে না। তিনি বলেন, আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, সরকার যে সুযোগটি দিয়েছে তাতে লাভ হবে না। কারণ, যার অবৈধ টাকা আছে জেনেশুনেই টাকা পাচার করেছেন তিনি। ফেরত আনার জন্য তো টাকা পাচার করেননি তিনি।
রাজস্ব বোর্ডের সংশ্লিষ্ট বিভাগের নীতি-নির্ধারক পর্যায়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশে টাকা ফিরিয়ে আনতে হলে প্রথমে টাকার অঙ্ক বৈধ করার ঘোষণা দিতে হবে। তারপর ঘোষিত অর্থ বৈধ উপায়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে আনতে হবে। ওই টাকা দেশে আসার পর নিজ নামে থাকা ব্যাংক হিসাবে জমা করতে হবে।
ব্যাংকে টাকা জমা হওয়ার পর প্রযোজ্য হারে চালানের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে আগে কর পরিশোধ করতে হবে। ১০০ টাকা নগদ আনলে ৭ টাকা কর দিতে হবে সরকারকে।
বিদেশে বাড়ি, ফ্ল্যাটসহ অন্যান্য স্থাবর/অস্থাবর সম্পদ বৈধ করতে হলে সম্পদের মূল্য ঘোষণা করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই তা কেনা দামের চেয়ে কম দেখানো যাবে না। এরপর সেই দরের ওপর ১৫ শতাংশ হারে দিতে হবে কর। এই সুবিধাভোগী তার ঘোষিত অর্থ বার্ষিক আয়কর রিটার্নে দেখাতে পারবেন। তবে অবশ্যই কর পরিশোধের প্রমাণপত্র রিটার্নের সঙ্গে জমা দিতে হবে। এনবিআরের নীতি-নির্ধারক পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, কেউ বাড়ি, গাড়ি অ্যাপার্টমেন্টের মূল্য ঘোষণা করতে চাইলে অবশ্যই বাজারমূল্য দেখাতে হবে এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় নথিপত্র দাখিল করতে হবে। কেউ যদি মিথ্যা সম্পদের হিসাব দেন, সন্দেহ হলে চ্যালেঞ্জ করতে পারবে এনবিআর।
নতুন বাজেটে অর্থ পাচারকারীদের বিশেষ সুবিধা দেয়ার ফলে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার। সমালোচনাকারীদের মতে, এই সুযোগ দিয়ে অর্থ পাচারকারীদের পুরস্কৃত করল সরকার। তবে বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল। তিনি জানান, পাশ্ববর্তীসহ অন্যান্য দেশেও অর্থ পাচারকারীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ইন্দোনেশিয়াসহ বিশ্বের ১৭টি দেশ পাচার করা টাকা বৈধ করার সুযোগ দিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সফল হয়েছে ইন্দোনেশিয়া। এই সুযোগ দেয়ার ফলে দেশটিতে প্রায় ৯৬০ কোটি ডলার দেশে ফেরত আসে। জানতে চাইলে গবেষণা সংস্থা পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকারের কিছু প্রিয়ভাজন লোক যারা টাকা পাচার করে আটকে গেছে, সন্দেহজনক ওইসব লোকদের টাকা বৈধ করতে এ সুযোগ দেয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘যারা টাকা পাচার করেছে তারা কি ফেরত আনার জন্য তা করেছে? অবৈধভাবে পাঠানো টাকা ফেরত সহজে আসে না।
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ